আমাদের নষ্ট রাজনীতি ও খুদে শিক্ষার্থীর সুস্পষ্ট আন্দোলন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

দেশের খুদে শিক্ষার্থীরা চমৎকার একটি আন্দোলনের সুচনা করে সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। গোটা পৃথিবীর মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাদের কীর্তি দেখেছে। আন্দোলন কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী তা উদাহরণসহ দেশের কথিত রাজনীতিকদের এরা শিখিয়ে দিতে চেয়েছে।এত চমৎকার, এত স্বচ্ছ ও নির্ভেজাল একটি আন্দোলন বহুদিন বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেনি। সারা দুনিয়া এরূপ আন্দোলন ক'টা দেখেছে কে জানে? 

কতই বা বয়স এদের? দেশ গড়ার এবং দেশকে সাজাবার এক অনন্য দৃঢ় মনোবল দেখিয়েছে এরা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কত অনিয়ম আর অনাচারে ছেয়ে গেছে প্রিয় মাতৃভুমি। প্রভাবশালীদের দাপটের কাছে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি তারা চমৎকার সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে। সড়কে মহাসড়কে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য ও যানবাহন চালকদের বেপরোয়া আচরণ তারা অতি সুন্দরভাবে জাতির সামনে তুলে ধরেছে। তাদের কতগুলো স্লোগান সত্যি মানুষের প্রাণ কেড়েছে। খুদে শিক্ষার্থীদের পবিত্র আন্দোলনটিকে ভিন্ন স্বার্থে ব্যবহারের এ ছিল অন্য এক ঘৃণ্য প্রয়াস। 'বাস মামা, আস্তে চালাও, মরে গেলে কাঁদবে মা '-এমন আকুতি বিকুতি লেখা প্ল্যাকার্ড নবীন শিক্ষার্থীর হাতে দেখে কার না মনে মায়া জেগে উঠেছে? নিজের জীবন নয়, মায়ের চোখের জল না ঝরানোর কী চমৎকার আকুতি! সন্তানহারা মায়ের কী যে কষ্ট সে কেবল ভুক্তভোগী মাই জানেন। নবীন শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠী নিহত হবার পর স্বচক্ষে দেখেছে সহপাঠীর মায়ের চোখের অশ্রু। এ তাদের বুক চিরে খান খান করে দিয়েছে। তারা উপলব্ধি করেছে তারা মারা গেলে তাদের মা ও এমনি করে কাঁদবে। জাতির বিবেক জাগ্রত করার জন্য এ একটি স্লোগানই কী যথেষ্ট নয়? আসলে আমাদের দেশটি যেন বিগত কয়টি বছরে সড়ক দুর্ঘটনার স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন সড়কে শত শত দুর্ঘটনা। ট্রাক-বাস কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার প্রাণ। শত স্বপ্নের সমাধি রচিত হয় পিচঢালা সড়কের বুকে। সড়ক চালকদের অসুস্থ ও অশুভ আচরণে প্রতিদিন খালি হয় কত মায়ের কোল। মায়ের কান্নায় কেঁপে ওঠে আল্লাহর আরস। তবু সড়কের সুস্থতা ফিরে আসে না। দিনে দিনে সে অসুস্থতা কেবলই বেড়ে চলে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক হিসেব মতে, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩শ' ৯৭ জন মানুষ নিহত হয়েছে। এ বছরের হিসেবটি নিশ্চয় আরো বেশি হবে। প্রতিদিন গড়ে বিশ জনের মত মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছেন। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের এক প্রতিবেদন অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দেশে ১ হাজার ৫৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহতের সংখ্যা ১,৮৮৩ এবং আহতের সংখ্যা ৩,৮৮১। আহত ও নিহতের বেশির ভাগ তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। প্রতি বছর হাজার হাজার মেধাবী ও কর্মক্ষম জনশক্তি হারিয়ে আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি না?                                               
সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা দুঃখ প্রকাশ করি। মর্মাহত হই। এতেই কি দায় শেষ হয়ে যায়? সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিলটি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। এতে কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। গত ক'দিনে আমাদের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যাদের এসব দেখাশোনা করার কথা, তারা কত যে বেখবর। দুর্ঘটনার খবরে তারা এতটুকু বিচলিত হয় না। বরং উল্টো হাসাহাসি করে। গাড়িঘোড়ার মালিকেরা এসবকে তোয়াক্কা করে বলে মনে হয় না। তাদের গাড়ির কাগজ নেই। ফিটনেস নেই। অদক্ষ চালক। চালকের লাইসেন্স নেই। ক্ষমতায় যারা তারাও উল্টো পথে গাড়ি চালায়। হাজার অনিয়ম তাদের মাঝে, যারা নিয়ম কানুন প্রয়োগ করবে। গোটা দেশটা যেন অনিয়মে ভরে গেছে। ট্রাফিক পুলিশ নির্বিকার। পয়সা খেয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। লক্কর ঝক্কর ও আনফিট গাড়িগুলো অলিখিত ফিটনেস পেয়ে যায়। এক দু'শ টাকা দিয়ে দিলে ড্রাইভারের আর লাইসেন্স দরকার পড়ে না। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র দেশ! 

ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের আরেকটি প্ল্যাকার্ড আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের করুণ চিত্র যেমন ফুটিয়ে তোলে, তেমনি দেশ পুনর্গঠনে তাদের অঙ্গীকার আমাদের আশায় বুকটা ভরে দেয়। ‘রাস্তা সাময়িক বন্ধ আছে। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে’। সত্যি কথা বলতে কী, ক্ষুদে শিক্ষার্থীগণ যে সব অনিয়ম দেখিয়ে দিয়েছে তার সংস্কার অতীব জরুরি। আইন প্রয়োগকারীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া একান্ত অপরিহার্য। গত ৩ আগস্ট কয়েকটি পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। এতে যে সংবাদটি উঠে এসেছে তা হলো, দেশে ত্রুটিপূর্ণ ফিটনেস বিহীন গাড়ি ঘোড়ার সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছাকাছি। আর প্রায় নয় লাখ ড্রাইভারের কোন লাইসেন্স নেই। দেশে এত পুলিশ থাকতে এসব আনফিট গাড়ি চলাচল করে কী করে? এত লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার! এদের কি ধরে বেঁধে জেলে নেয়া যায় না? সবই পারা যায়। 
আমাদের সোনার ছেলেরা জেগেছে। ওরা দেখিয়ে দিয়েছে, চাইলে কী না পারা যায়। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা কোনো কঠিন কাজ নয়। সদিচ্ছাই যথেষ্ট। আমাদের শিশু শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াওয়ে মেতে ওঠেনি। তারা রাস্তায় নেমে যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষায় ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতা করেছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে। তারা 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস', 'আমিই বাংলাদেশ' বা 'নিরাপদ সড়ক চাই' জাতীয় স্লোগান দিয়েছে। রিকশা, প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন যানবাহনকে আলাদা আলাদা লেনে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করেছে। ড্রাইভারের লাইসেন্স ও গাড়ি ঘোড়ার ফিটনেস দেখেছে। আমাদের এখন দুর্ভাগ্য এই যে, দেশে ভাসানী, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী কিংবা বঙ্গবন্ধুর মত কোনো নেতা নেই। ভাগ্যিস, গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত একজন শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পেরেছে। নিহত শিক্ষার্থীদের কলেজ পাঁচটি বাস গাড়ি পেয়েছে। তাদের পরিবার পরিজন যথাযথ সমবেদনা ও সহানুভুতি পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রায় সব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেদিন বলেছেন, 'আমি শিক্ষার্থীদের সাথে আছি', সেদিন থেকে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রশমিত হতে শুরু করে। গতদিন মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বেশ কিছু আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। আশা করা যায়, শীঘ্রই এসবের বাস্তবায়ন শুরু হবে। যে কোন কিছুতে একটু সময় লাগা খুব স্বাভাবিক। আমাদের সকলকে ধৈর্য ধরে একটু সময় দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে।

  

এরপরও আমাদের শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে সরকারি দল, বিরোধী দল কম খেলা খেলেনি। বিরোধী দল বিগত ক'বছরে দেশে কোন অর্থবহ আন্দোলন করতে পারেনি। ছাত্রদের এ আন্দোলনকে তারা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দিতে চেয়েছে। ছাত্ররা যখন পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে শুরু করবে, ঠিক তখন বিরোধী দলের যুবক স্কুল-কলেজের ড্রেস পরে ভুয়া আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। গত ক'দিনে ঢাকাসহ বেশ ক'টি শহরে স্কুল ড্রেস ও আইডি কার্ড তৈরির দোকানগুলোতে নাকি প্রচণ্ড ভীড় লক্ষ্য করা গেছে। দোকানগুলো নাকি বেচাবিক্রি করে একেবারে খালি হয়ে পড়েছে। বিএনপির নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর টেলিফোনে আন্দোলন উস্কে দেবার বিষয়টি বিবেকবান যে কোন নাগরিককে হতাশ ও ব্যথিত না করে পারেনি। কেননা তার মত একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিকের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অন্য কিছু। এদিকে সরকারি মদদপুষ্ট পরিবহন সমিতিগুলো অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের নামে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বানচালের কম চেষ্টা করেনি। তাতে এ কয়দিনে সাধারণ মানুষ কী যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছে, তার খবর একমাত্র ভুক্তভোগীই বলতে পারে। কোনো কোনো স্থানে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে। তারা কাজটি মোটে ও ভালো করেনি। এদিকে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের কথা কী আর বলব। কথায় কথায় তিনি শিক্ষকদের শাসান। শিক্ষকদের ওপর চড়াও হন। সেদিন তিনি বলেছেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে না গেলে প্রতিষ্ঠান প্রধান দায়ী হবেন। এটি কেমন কথা? ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে নেমেছে। আন্দোলন করে সাফল্য পেয়েছে। তাদের সোনালী অর্জনকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তাদের নির্দোষ দেখাবার জন্য শিক্ষকদের দোষ খুঁজাখুঁজি কি না কে জানে? গতদিন সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে সরকার একটি কাজের কাজ করেছে। না হয় গুজবে দেশটা তলিয়ে যেত। এজন্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়েছে বটে। কিন্তু আমাদের দেশটা বেঁচেছে। গুজব ছড়াতে মনে হয় বিশ্বে আমাদের জুড়ি নেই। সরকারের উচিত হবে ফেসবুক ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা। তাদের এসবের ওপর নজরদারি রাখা। না হয় এরা যে কোনো সময় অযথা একটা গুজব ছড়িয়ে সারাটা দেশ পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।       

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট,  সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025968551635742