আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন নয় একটি মূল্যহীন কাগজ প্রাপ্তি মাত্র

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একজন মানুষের নিঃস্ব হওয়ার সহজ দুটি পথ আছে। প্রথমত, তার কোনো আপনজন যদি দীর্ঘমেয়াদি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দ্বিতীয়ত, তিনি যদি কোনো মামলায় জড়ান। দুই ক্ষেত্রেই বেশ কিছু পাশর্^প্রতিক্রিয়া আছে; যা নিঃস্ব হওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। যেমন ধরুন আপনার কোনো নিকটজন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে করতে তার কিডনি বিকল হবে। তখন নিয়মিত ডায়ালাইসিস দিতে হবে। কিডনি রোগীর হার্টের সমস্যা অবধারিত। অর্থাৎ আপনি হাসপাতালের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে ফতুর হয়ে যাবেন। মামলারও ডালপালা বিস্তার লাভ করে দ্রুত। জমিজমার মামলা থেকে মারামারির মামলা, এরপর হত্যা মামলা, নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মামলা। কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে নিজের অজান্তেই আপনি নিঃস্ব, রিক্ত, ভিখারি হয়ে যাবেন। শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী একাধারে চিকিৎসক এবং আইনজীবী। শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার। এ দুজনের নেতৃত্বে গত এক বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা রিক্ত, নিঃস্ব এবং সর্বহারা হয়ে গেছে। কদিন আগে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে গিয়েছিলাম। ওই সংস্থাটি আরও ১৫টি সংগঠন মিলে ‘নিরাপদে স্কুলে ফেরা’ একটি কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, স্কুলে বাচ্চাদের ফেরানোর চ্যালেঞ্জ কী? উত্তর শুনে আমি রীতিমতো আঁতকে উঠলাম। একজন কর্মী আমাকে বললেন, ‘আমাদের শিক্ষা এক বছর নয় আসলে ২৫ বছর পিছিয়ে গেছে।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘গ্রামে একটা বাচ্চা স্কুলে যেত। স্কুল বন্ধের পর তার বাবা হয়তো তাকে দোকানে বসিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা আয়-রোজগার করছে। ওই বাবা আর কিছুতেই তাকে স্কুলে ফিরতে দেবে না। লেখাপড়ার চেয়ে আয়-রোজগার ওই পিতার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

বাংলাদেশে শিশুদের নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে এক ভয়াবহ শিক্ষার্থী ‘ঝরে পড়া’র ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। শুধু বাচ্চাদের শিক্ষায় নয়। উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার অবস্থাও গত এক বছরে উদ্বেগজনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সেদিন এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলো। ছেলেটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাবা নেই। ঢাকায় চারটি টিউশনি করত। এ টাকা দিয়ে সে নিজে চলত, তার মাকেও চালাত। করোনার কারণে তার সব টিউশনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ সময় তার কী দুর্বিষহ অবস্থা হয়েছিল, সে বিবরণ এখানে নাই বা দিলাম। তিন মাস আগে ছেলেটি আবার তিনটি টিউশনি ফেরত পেয়েছে। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে একটা মেসে থাকছে। ছেলেটি বলছিল, মেসের পরিবেশ জঘন্য। সিএনজি চালক থেকে শুরু করে হকাররা পর্যন্ত থাকে। অনেকে নেশাটেশা করে আসে। গাদাগাদি করে তাকে কোনো রকমে রাত কাটাতে হয়। বন্ধু-বান্ধব মিলে একটা বাড়ি নেওয়ার চেষ্টা করেছিল ছেলেটি। কিন্তু সেখানে যে ভাড়া দিতে হবে তা দিয়ে তার মাকে টাকা পাঠানো সম্ভব নয়।

তাই এখানেই থাকে সে। ছেলেটি আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, করোনা কি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলেই আছে? আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটি মেয়ে আমাকে কদিন আগে টেলিফোন করল। মেয়েটির অনার্স পরীক্ষা আটকে আছে। দীর্ঘ করোনায় তার বাবা-মা এখন তার জন্য পাত্র খুঁজছে। সৌদি আরবপ্রবাসী একজনকে পছন্দ করেছে অভিভাবকরা। বাবা-মা মেয়েটিকে বলেছেন, আর লেখাপড়ার দরকার নেই, বিয়ে করে সৌদি যাও। প্রতিদিন চারপাশে এ রকম বহু শিক্ষার্থীর আর্তনাদ শুনি। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ কদিন আগে একটি শিরোনাম দেখে চমকে উঠলাম। করোনায় আত্মহত্যা অনেক বেড়েছে। এ সময় ‘কিশোর গ্যাং’ একটা ব্যাধি হিসেবে আমাদের সামনে এসেছে। বাল্যবিয়ে বাড়ছে হু হু করে। ধর্ষণ বেড়েছে। এসবই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশর্^প্রতিক্রিয়া।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই সব বুঝেশুনে সুচিন্তিতভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তারা নিশ্চয়ই জ্ঞানী-বিজ্ঞজন। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষ এখন বেশ ধন্দে পড়েছি। কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এত দিন বন্ধ? আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এত দিন, এভাবে বন্ধ থাকেনি। এমন যদি হতো ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো এ দেশে লকডাউন চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা অসম্ভব, তাহলে বুঝতাম। কিন্তু বাংলাদেশে এখন সবকিছু স্বাভাবিক। রাস্তায় তীব্র যানজট। বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সিনেমা হল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট জমজমাট। এমনকি রাতে পাঁচ তারকা হোটেলে ডিসকো নাইটের ওপরও কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সবকিছু খুলে দিয়ে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক হলগুলো বন্ধ রাখা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। যে শিশুটি স্কুলে যেতে পারছে না তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারছে না, তাকে তার মা মাস্ক ছাড়া দিব্যি সবজি বাজারের ভিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি করোনা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? আমরা অশিক্ষিত মূর্খরা সাদা চোখে এটাই দেখি। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং শিক্ষার কর্মকর্তারা বিদ্বান, জ্ঞানী। তাঁরা নিশ্চয়ই এ দীর্ঘ বন্ধের গূঢ় রহস্য জানেন। কেন এক বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ? কেন বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ একেবারে সহনীয় মাত্রায় আসার পরও শিক্ষায়তন খুলে দেওয়া হচ্ছে না? এ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্ঞান, গবেষণা ও সুদূরপ্রসারী ভাবনাগুলো আবিষ্কার করলাম। এক বছর শিক্ষার তালায় আমরা শুধু ক্ষতি দেখছি, লাভ দেখছি না। একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে এতে বহুমাত্রিক লাভ আছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে উচ্চমাধ্যমিকসহ বিভিন্ন বার্ষিক পরীক্ষায় অটো পাস দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এটি একটি অভাবনীয় এবং যুগান্তকারী উদ্যোগ। এর ফলে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সব শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থী শতভাগ পাস করেছে। বাংলাদেশে শিক্ষায় এক অভূতপূর্ব অর্জন। এ সাফল্য কেউ কখনো অর্জন করতে পারেনি। অতীতের সরকারগুলো শিক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের চেষ্টা করেছিল। কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরও বন্ধ রেখে আরও কয়েক বছর এভাবে অটো পাস দিলে, একটি ‘শতভাগ’ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী পাওয়া যাবে। দেশের শিশু-কিশোরের শতভাগ শিক্ষিত করার এ মহতী উদ্যোগ আমরা বুঝতে পারছি না।

বাংলাদেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা অনেক। তারা খায় দায় ফুর্তি করে। বিদেশে গিয়ে আমোদে আহ্লাদে টাকা ওড়ায়। ছেলেমেয়েদের পড়ায় আট টাকার সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একই অবস্থা। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দীর্ঘায়িত হলে এসব বেকুব অভিভাবকের টনক নড়বে। এখন তারা আমোদ-ফুর্তির খরচ বাঁচিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য বিদেশে পাঠাবেন। এখন শুধু মুষ্টিমেয় কিছু ছেলেমেয়ে বিদেশে যায় উচ্চশিক্ষার জন্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা এভাবে ঝুলে থাকলে অভিভাবকদের আর কোনো পথ থাকবে না। তারা বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠাবেন। শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার হিড়িক পড়বে। এর ফলে জাতির কি অসাধারণ লাভ হবে ভেবে দেখেছেন? একদিকে রাষ্ট্রের শিক্ষার খরচ কমে যাবে। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ কিশোর-তরুণ অভিবাসনের সুযোগ পাবে। এরা বিদেশে থেকে যাবে। পিঁয়াজ কাটুক আর টয়লেট পরিষ্কার করুক, টাকা তো কামাবে। ফলে আমাদের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি দ্বিগুণ হবে। এ দেশে মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা সমালোচনা। এসব সমালোচনা শুনতে শুনতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কান ঝালাপালা। এ সমালোচনার চেয়ে তালাই উত্তম। এখন যার যে রকম মানসম্মত শিক্ষা দরকার সে সেখানে যাও। ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে খুশি। মানসম্মত শিক্ষার এ রকম অবারিত সুযোগ তৈরির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারে।

বাংলাদেশে এখন সবাই বিবিএ, এমবিএ পড়তে চায়। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে ধান চাষ করবে কে? খামার করবে কে? তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে কৃষক-শ্রমিকের বিপুল কর্মীবাহিনী তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নিম্নবিত্ত ঘরে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই ‘মানসম্মত’ শিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে পারবে না। ফলে তাদের আর শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হবে না। ফলে তারা খেতে খামারে কলকারখানায় কাজ করবে। মেহনতি জনতা হিসেবে দেশের জন্য অবদান রাখবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই বাবু হয়ে যায়। শার্ট-প্যান্ট পরার রোগ ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, বিদেশে পড়ার মুরোদ নেই যাদের তাদের এখন অটোমেটিক খেত খামারে কাজ করতে হবে। কী চমৎকার সমাধান। এ রকম না হলে যেভাবে শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছিল তাতে আগামী দিনে তো ধান কাটার মজুর পাওয়াই যেত না। এবার করোনার সময়ই তো আমরা দেখলাম ধান কাটার লোক খুঁজতে কত বিপত্তি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্ভবত এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদি বন্ধ রাখার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আর কিছুদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলে কৃষিমজুর এবং শ্রমিকে ভরে যাবে দেশ। পত্রপত্রিকায় দেখি প্রায়ই সনদ জালিয়াতির খবর।

বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে একজন বিচারপতি হলেন। পরে দেখা গেল তার সার্টিফিকেটই জাল। আওয়ামী লীগের আমলেও সার্টিফিকেট জালিয়াতি চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সেদিন দেখলাম এক চিকিৎসকের সনদও নাকি জাল। নীলক্ষেতে গেলেই নাকি যে কোনো সার্টিফিকেট অবিকল পাওয়া যায়। কী কেলেঙ্কারি! কোনটা আসল সনদ, কোনটা নকল সাধারণ মানুষ বুঝবে কীভাবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় আবিষ্কৃত ‘অটো পাস’ পদ্ধতি সার্টিফিকেট জালিয়াতির ক্যান্সার থেকে জাতিকে নিশ্চিত মুক্তি দেবে। অটো পাসের ফলে কেউ ফেল করবে না। ফলে তাদের জাল সার্টিফিকেটের জন্য নীলক্ষেতেও যেতে হবে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে আরেক দুর্নীতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হতো। প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রাথমিক থেকে শুরু করে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা। সব পরীক্ষাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস ছিল এক বিষফোঁড়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা থাকলে পরীক্ষার ঝামেলা নেই। তাই প্রশ্নপত্র ফাঁসেরও কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তাই এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে অটো পাস দিলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো শঙ্কা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই মহান সিদ্ধান্ত জাতিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারি থেকে মুক্তি দিল। ভাবুন তো কী বিরাট অর্জন!

তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক হলগুলো বন্ধ রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নীরব বিপ্লবের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে কৃষি ও মৎস্য খাতে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। কদিন আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছেন এখন তো ক্লাস নেই, আপনি কী করেন? উত্তরে ওই শিক্ষক বললেন, ‘উঠানে লাউয়ের চারা লাগিয়েছি। কিছু সবজি চাষ করছি। এভাবেই সময় কেটে যায়।’ আঃ কী চমৎকার। বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন এবং আমিষের চাহিদা মেটানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মেটাতে সরকার হিমশিম খায়। অথচ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিপ্লব করার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতির সামনে এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা চিন্তা করুন। কত একর জমি অকর্ষিতভাবে অনাদরে পড়ে আছে। এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল এলাকা, এখানে ছেলেমেয়েরা বসে শুধু ঝালমুড়ি খায়। এটা কিছু হলো? দীর্ঘ এক বছরে তালা ঝুলিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কত জমি অনাদরে অবহেলায় পড়ে আছে। কত পুকুর যত্নহীন। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এ সুযোগে দেশে যত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খালি জায়গা আছে সেখানে কৃষিকাজ, মাছ চাষ করা যেতে পারে।

আহমদ ছফার ‘গাভীবৃত্তান্ত’ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে গরু-ছাগলের খামারও করা যেতে পারে। এর ফলে দেশে একটি খাদ্য বিপ্লব হবে। অর্থনীতি মজবুত হবে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। আর এ কৃষিকাজ, খামার, মাছ চাষ দেখাশোনা তদারকির জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ এনে আবাসিক হলগুলোয় রাখা যাবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার যে পথ দেখাল তা আমরা যারা দেখছি না তারা তো অকাট মূর্খ বটে। এত দিন ‘তথাকথিত’ পন্ডিতরা বলতেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন নয় একটি মূল্যহীন কাগজ (সার্টিফিকেট) প্রাপ্তি মাত্র। এ দেশে ফলিত রসায়ন পড়ে অনেকে ব্যাংকের কেরানি হন। বাংলায় পড়ে প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হন। চিকিৎসক চাকরি করেন রাষ্ট্রদূতের। সব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মজীবনে গিয়ে আবর্জনায় পরিণত হয়। এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাগজে-কলমে দেখাল আমাদের শিক্ষা কত মূল্যহীন। এত মূল্যহীন যে এর চেয়ে কাঁচাবাজারে সবজি বেচাকেনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়ে বাস, লঞ্চ, ট্রেনে চলাচল অনেক প্রয়োজনীয়। এর চেয়ে মদের পানশালা ঢের জরুরি। শিক্ষা সে তো শুধু কিছু মূল্যহীন কাগজ। সে কাগজ যে পড়াশোনা না করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেও দেওয়া যায় তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দিল আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তবে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অক্সফোর্ডের জন্য বিস্ময়কর গবেষণার খোরাক দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোরতা, উদ্বেগ এবং আতঙ্ক আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে একটি ধারণা দিয়েছে। তা হলো ‘করোনা’র সঙ্গে লেখাপড়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভীর ও স্পর্শকাতর সম্পর্ক রয়েছে। বাজারে, হাটে, বিয়ের অনুষ্ঠানে, জনসভায়, নির্বাচনী প্রচারণায় অবাধ মেলামেশায় করোনা না ছড়ালেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুত করোনা ছড়ায়। লেখাপড়া করলেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সমূহ ঝুঁকি তৈরি হয়। এ কারণেই হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর এ অভিনব ধারণা যদি শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় গবেষণায়, তাহলে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য অবধারিত। সে পুরস্কার নিশ্চয়ই আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী পাবেন। তখন নিশ্চয়ই বাল্যশিক্ষা বই পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’র বদলে চালু হবে ‘লেখাপড়া করে যে করোনায় মরে সে!’

               

লেখক : সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় - dainik shiksha হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে - dainik shiksha সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড - dainik shiksha মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00270676612854