আমাদের শিক্ষা ও নৈতিকতা

নূরে আলম সিদ্দিকী নূর |

আমরা যারা অন্ততপক্ষে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি, তারা সবাই এই কথাটি পড়ে এসেছি যে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এই কথাটি মুখস্থ করেছি, পরীক্ষায় খাতায় প্রশ্নের উত্তরেও লিখেছি। আমরা সবাই আমাদের মহান শিক্ষকের মুখ থেকে এই কথাটি শুনে শুনেই বড় হয়েছি, অনেক বড়! অনেকে আকাশ ছো্ঁয়া সম্মানও পেয়েছি বা এখনও পাচ্ছি। একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একই বেঞ্চে বসে একই শিক্ষকের নিকট থেকে একই বিষয়ের ওপর শিক্ষা নিয়েও একেকজন একেক জায়গায়। এই শিক্ষা নিয়ে কেউবা ডাক্তার হয়েছেন, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন, কেউবা হয়েছে বুদ্ধিজীবী আবার কেউবা শিক্ষকও হয়েছেন। এই ঘটনা নিয়মিত। 

যদি বাংলাদেশের কথাই ধরি, এদেশ একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি ছিল! একসময় এদেশে শিক্ষার হার যেমন কম ছিল, বিপরীতে দরিদ্রতার হারও বেশি ছিল। ওই সময় এদেশের মানুষ আর্থিক দিক থেকেই তো বেশি দরিদ্র ছিল বলে জানি, কিন্তু এখন এদেশের মানুষের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর চেয়ে শিক্ষকের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রবীণদের মুখে গল্প শুনেছি, আজ থেকে ৭০ বা ৮০ বছর আগে এদেশের অনেক মানুষ দু‘বেলা পেট ভরে খেত পেত না। দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। একমুঠো ভাতের জন্য বা এক বাটি ভাতের মাড়ের অভাবে আত্মহত্যা করেছে এর নজিরও কম না!

যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে বর্তমান সময়ে আমরা অনেক এগিয়ে রয়েছি। শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও বিনোদনে সবদিক থেকেই আমরা এগিয়ে। যদিও এক সময় এদেশের মানুষ ভাতের অভাবে না খেয়ে মরেছে, আর এখন অনেক বাড়িতে ভাতের অভাব নেই, শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও বিনোদনেরও অভাব নেই। এখন আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেকে ভাতের অভাবে মরে না, মরে ফেন্সিডিলের অভাবে, মরে ইয়াবা’র অভাবে! আর এসব ‘দামি’ খাবারের অভাবে যারা মরছে, তাদের অধিকাংশই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান, যেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যা অনেক কম। যারা এসব খাবার খাচ্ছে তারাও তো শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। তাদের বাড়িতে সন্তানকে মানুষ করার জন্য দিনে দু’বেলা প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়। আমাদের দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এ+ পাওয়া ছাত্রছাত্রী বের হচ্ছে। শুধু কি তাই, দেশের সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোমলমতি শিশুদের নৈতিক শিক্ষায় উন্নত করার আপ্রাণ চেষ্টায় নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে লাখ লাখ বইও সরবরাহ করেছেন। এই বইগুলো তো ছাত্রছাত্রীরা পড়ছে। পড়ে পরীক্ষায় এ-প্লাসও পাচ্ছে। এই বইগুলো পড়ে আমাদের সন্তানেরা তো নৈতিক শিক্ষায় উন্নত হবার কথা, নৈতিক কাজে তো এ-প্লাস পাবার কথা, আলোর পথে পা বাড়ানোর কথা। শিক্ষা দিয়ে জাতির মেরুদণ্ড সোজা করার কথা। কিন্তু ঘটছেটা কী? মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পড়া শেষ করে যাদের বিশ্ববিদ্যালয় নামক সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে যাবার কথা তাদের অনেকে এখন মাদকাসক্ত সংশোধনাগারে বা নিরাপদ আশ্রয় জেলখানায়! ভাবা যায়!

একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো। আপনার বয়স যদি আজ ৫০ বছর হয়, আপনি যে সময়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন সে সময়ে আপনার বিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র কি বিড়ি-সিগারেট টানত? শার্টের ওপরের বুকের বোতাম কতটি খুলে রাখতেন? শিক্ষককে লক্ষ্য করে কোনো ছাত্রকে আঙুল তুলে কথা বলতে দেখেছেন? অবশ্যই দেখেননি। কিন্তু আজ? চোখ-কান খোলা রাখুন সব পরিস্কার দেখতে পাবেন। দেখেও না দেখার ভান করলে কিছুই হবে না! সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে অবস্থা আরও ভয়াবহ। একটা সময় ছিল, যে সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা তাদের জন্মদিন উপলক্ষে চকোলেট বা আইস্ক্রিম খেয়ে আনন্দ করত। কিন্তু এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নামক ছাত্রছাত্রীরা এখন চকলেটের পাশাপাশি বিশেষ পানীয় পান করেন যা দেশে নিষিদ্ধ! আমি সব সন্তানের কথা বলছি না। শুধু যারা অন্ধকারে পা বাড়াচ্ছে, তাদের কথাই বলছি। এদেশে হাজারও সন্তান আছেন যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করি। তারা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।

এখন আপনার মনে প্রশ্ন হতে পারে, নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞ শিক্ষক, নৈতিক শিক্ষার বই, দু’বেলা প্রাইভেট টিউটর, সন্তানের জন্য তার মায়ের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করা এতো কিছুর পরও কেন আমাদের সন্তানেরা আলোর পথ দেখছে না? এবার একটু ভাবুন তো, আপনি যে প্রতিষ্ঠানে আপনার সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন তা কি মানসম্মত? প্রতিষ্ঠানের পড়ার পরিবেশ কেমন? প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্র কেমন? আপনার সন্তান কার সাথে চলাফেরা করে সে বিষয়ে আপনি বা আপনার শিক্ষক নিয়মিত খোঁজ খবর নেন কিনা? সবচেয়ে দামি কথা হচ্ছে, নৈতিক শিক্ষার জন্য বাবা-মা’ই প্রধান শিক্ষক। তারপরেই প্রতিষ্ঠানের ভাল শিক্ষক দ্বারা নৈতিক শিক্ষার পাঠদানের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষায় সন্তানকে উন্নত করে তোলা।

এবার আসি অন্য দিকে। যে প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক নেশা করেন, মাদক ব্যবসার সাথে যুক্ত, সে প্রতিষ্ঠান মাদকমুক্ত হবার সম্ভাবনা কতটুকু? সে শিক্ষক দিয়ে নৈতিক শিক্ষার বই পড়ানো হলে তা আপনার সন্তানের জীবনে কতখানি কাজে লাগবে? আবারও বলে রাখি, আমি সব শিক্ষকের কথা বলছি না। বলছি তাদের কথা যাদের সাথে মাদকের সম্পর্কটা দৃঢ়। যে শিক্ষক ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়ার সময় ঘুষ নামক ১০-১৫ লাখ টাকা ডোনেশন দিয়ে মেধা তালিকায় প্রথম স্থানে থাকা নিরীহ মানুষটিকে পরাস্ত করে গর্বের সাথে শিক্ষকতা করছেন সে শিক্ষক দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে আপনি আপনার সন্তানের জন্য কতটুকু নৈতিক শিক্ষা আশা করবেন? আপনার সন্তানটি নৈতিক শিক্ষার বইটি মুখস্থ করে এ-প্লাস পেয়েছে নাকি তা থেকে সামান্য হলেও নৈতিক শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছে সেটাও কিন্তু দেখার বিষয়। আমাদের সন্তানরা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত বা সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হলে তারা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের পর হয়তো অনেক দামী অফিসার হবেন, এমপি-মন্ত্রী বা সচিব হবেন। আগামিতে এ নৈতিক শিক্ষাবিহীন ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের দেশে বিদ্যুতের কারখানা থাকবে, বিদ্যুতের খুঁটি থাকবে না, আপনার বাড়িতে মাঝে মাঝে বিদ্যুত আসবে, কয়লার খনি থাকবে কিন্তু দিনের বেলাও কোটি টাকার কয়লা উধাও হবে, রাস্তায় গাড়ি থাকবে পুলিশ থাকবে, কিন্তু গাড়ির কাগজ থাকবে না, ভোটের দিনে ভোট চলবেই ভোটার লাগবে না!আর হয়তো বা একটি ঘটনা ঘটবে- লাইব্রেরীতে অনেক ভাল ভাল বই থাকবে। কিন্তু লাইব্রেরী পাঠক শুন্য হবে, লাইব্রেরিতে পড়ার টেবিলে ধূলোর স্তুপ পড়ে থাকবে!

আগামির সোনার বাঙলা গড়তে হলে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক চরিত্রে সফল শিক্ষকের দ্বারা অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে আর এটিই এখন আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর এ জন্য প্রয়োজন হবে আজ থেকেই চিন্তার পরিবর্তন, নৈতিক চিন্তার উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন। 


লেখক: সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে - dainik shiksha তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত - dainik shiksha বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023698806762695