আমাদের শিক্ষা নিয়ে কিছু কথা

রহিম আব্দুর রহিম |

জাপানের শিশুরা নিয়মিত স্কুলের আঙিনা পরিষ্কার করে। শ্রেণিকক্ষ পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটিও তারাই করে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা এর উল্টো কাজটি করে। এর কারণ কি? পাঠ্যসূচির বাইরেও যে পরিবেশ-প্রতিবেশ শিক্ষার প্রয়োজন আছে তা আমাদের পরিবার, প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজ দিতে পারেনি। জাপান দলের সমর্থকরা খেলার মাঠে তাদের দল হেরে গেলেও তারা খেলা শেষে মাঠ পরিষ্কারের কাজটিও শেষ করে মাঠ ত্যাগ করে। অথচ আমাদের পছন্দের দল হেরে গেলে আমরা স্টেডিয়ামের সম্পত্তি বিনষ্ট, প্রতিপক্ষের সঙ্গে দাঙ্গায় লিপ্ত হই।

যে যুগে সুইজারল্যান্ডের জেলখানাগুলো পার্কে পরিণত করা হচ্ছে আসামি শূন্য হওয়ায়, সে যুগে আমাদের জেলখানাগুলোতে কয়েদিতে ঠাসাঠাসি। নেদারল্যান্ডের পথচলা মন্ত্রীরাও রাস্তায় পড়ে থাকা পশুপাখির মল-মূত্র, আবর্জনা নিজ হাতে পরিষ্কার করে, অথচ আমাদের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের আচরণগত এত বড় তফাতের কারণ তাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গবেষণালব্ধ, প্রকৃতি, পরিবেশ এবং পেশাগত। সেখানে শারিরীক শ্রম ও মেধার সমন্বয়ে তৈরি হয় যোগ্য, দক্ষ, সৃজনশীল, মানবিক ও আদর্শিক মানবসম্পদ। অথচ আমরা শিক্ষায় শুধু গুণগতমান বৃদ্ধির কথাই বলে যাচ্ছি। যা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি বছর সরকার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছেন। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে কি ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন তা এখনও আমাদের এখানে গৃহীত হয়নি।

গত ৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গবেষণা সমন্ধে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশের অপ্রতুল সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। কারণ, গবেষণা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি চান বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা হোক। প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য এমন সময় দিয়েছেন, যখন আমাদের দেশে জোড়া-তালি দেয়া, অন্যের থিসিস চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়ে অথবা অনলাইনে বিদেশ থেকে টাকার বিনিময়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের হিড়িক পড়েছে। পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতি বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিটও হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের এক শিক্ষক ৯৮ শতাংশ হুবহু নকল পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভের মাধ্যমে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষক পিএইডি জালিয়াতি করেছেন। তিনি এখন একটি বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচায। 

হাজার বছরের পুরোনো ধ্যান-ধারণা কিংবা ব্যক্তি মানুষের একক চিন্তার প্রতিফলন যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে সময় উপযোগী শিক্ষা এবং শিক্ষাপদ্ধতি, নীতি, মান-গুণের আমূল পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। যে শিক্ষায় থাকবে জীবন সম্পৃক্ততা, আনন্দঘন পরিবেশ, শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা স্বপ্নের বাস্তবায়ন।

 গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থী তাদের ভবিষ্যৎ পেশা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা নিয়ে হতাশ। ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ পছন্দের পেশার কাজ পায় না। ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউটের খাতায় নাম লেখায়। বাবা মা’র ইচ্ছা পূরণ করতে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারে না।

শিক্ষার্থীরা তাদের ইচ্ছা বা স্বপ্নমাফিক পড়তে পারছে না বলেই শিক্ষিত বেকারের মিছিল বাড়ছে। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে এমন, যেখানে উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে, পেশাগত শিক্ষিতের হার বাড়বে, কর্মসংস্থান খুঁজবে না বরং কর্ম সৃষ্টি করবে। আর এটা করতে হলে, আমাদের হ-য-ব-র-ল শিক্ষাব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।
 
বর্তমান সময় কি ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োজন এ ব্যাপারে দেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষা গবেষক, শিক্ষকদের কাছে গবেষণাপত্র আহ্বান করা যেতে পারে। প্রত্যেক জেলা থেকে শিক্ষা সংস্কারে প্রস্তাবনা আহ্বান করা যেতে পারে। যা সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট জমা করবেন। প্রত্যেক জেলায় এ সকল প্রস্তাবনা নিয়ে সেমিনার আকারে দু’দিনব্যাপী যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে একটি প্রস্তাবনা গৃহীত হবে। দেশের ৬৪ জেলার ৬৪টি প্রস্তাবনা থাকবে। আট বিভাগে ৮ টি করে প্রস্তাবনা নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে সপ্তাহ ধরে যুক্তিতর্ক চলবে। উপস্থাপিত প্রস্তাবনার যৌক্তিক পরিমার্জন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে একটি পরিচ্ছন্ন প্রস্তাবনা জাতীয় পর্যায়ে জমা হবে।
 
আট বিভাগ থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবনা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে পুনরায় সপ্তাহব্যাপী যুক্তিতর্ক চলবে। প্রতিটি যুক্তিতর্কে প্রস্তাবনা জমাদানকারী প্রত্যেক জেলার একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন। যে বিষয়টি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দেখবেন। শিক্ষা সংষ্কারের এ ধরনের গঠনমূলক একটি কাঠামো এখন সময়ের প্রত্যাশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক: রহিম আব্দুর রহিম, গলেহাহাট ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, পঞ্চগড় সদর, পঞ্চগড়।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030429363250732