অরিত্রির আত্মহত্যাআমাদের সকলেরই দায় আছে

সুলতানা কামাল |

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রি। খবরে প্রকাশ, পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে যাওয়ার কারণে তার বাবা-মাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ অপমান করে। এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অরিত্রি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এটা একটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। অরিত্রি যে এভাবে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলো এ জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ দায়ী। আমরা কেউ এ দায় এড়াতে পারি না। আমরা একে অপরকে অপদস্থ করে পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসার কৌশলকেই আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি। 

এটা আমাদের সাংস্কৃতিক বিপর্যয় বলেই আমি মনে করি। পরীক্ষার হলে মেয়েটির কাছে মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। 

অভিযোগ আছে, মেয়েটি পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করছিল। ফলে শিক্ষকরা তাকে তিরস্কার করেছেন। পরবর্তী সময়ে তার বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে এসে অপমান করা হয়। জানা গেছে, ক্ষমা চেয়েও রেহাই পাননি অরিত্রির বাবা।

আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শিশু-কিশোররা যায় শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে; আমরা জেনে এসেছি চরিত্র গঠনও তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছাত্রছাত্রীরা অবশ্যই ভুল করতে পারে, সেটা অন্যায়ের পর্যায়েও পড়তে পারে। শিক্ষকরা তাদের সেই ভুল ধরিয়ে দেবেন, তাকে সঠিক পথে আনার জন্য যা যা করণীয় সবই করবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। অন্যায় শুধরাবার কোনো সুযোগই যদি সে না পেল এবং সেটার কারণে তাকে একেবারে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হলো, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ার মধ্যে মৌলিক কোনো ত্রুটি রয়ে গেছে। তার বড় একটি লক্ষণ হলো শিক্ষকদের আচরণে সহমর্মিতা ও সৌজন্যবোধের অভাব। বড়দের চরিত্রে, বিশেষত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সৌজন্যবোধ থাকতে হয়, যাতে সার্বিকভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌজন্যবোধ তৈরি হয়। শিক্ষকদেরই যদি এর অভাব থাকে; তবে আমাদের শিক্ষার্থীরা কার কাছ থেকে শিখবে, কোথা থেকে শিখবে। সন্তানের অসদাচরণে বিপন্ন বোধ করা বাবাকে যেভাবে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের কর্তৃপক্ষ অপমান ও অপদস্থ করল তা আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির চরিত্র নিয়ে ভাবিত করে বৈকি। 

আমরা যে সমাজে বাস করি, সেখানে একে অপরকে পেছনে ফেলে যেভাবেই হোক নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে নেওয়াকেই সাফল্য বলে বাহবা দেওয়া হয়। যে কোনো কৌশলে অন্যের চেয়ে নিজেকে শ্রেয় প্রমাণ করাটাই আমাদের সন্তানদের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি আমরা। আমাদের তৈরি সমাজের এই অসম্ভব রেষারেষির নিয়মেই এক পর্যায়ে অরিত্রি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। 

ভালো ফল করার চাপের মধ্যে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা কী শিখছে, কতটা শিখছে এবং কীভাবে শিখছে এসব প্রশ্ন বহুদিন ধরে উত্থাপিত হয়ে আসছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত নিয়ম শিক্ষার্থীদের মানস গঠনে কতটা সহায়ক ভূমিকা রাখছে, সেসবও দেখার সময় এসেছে। ভয়মুক্ত সমাজের জন্য আমাদের হাজারো প্রচেষ্টা সত্যিই বিফলে যাবে, যদি আমরা আগামী দিনের প্রতিনিধি এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীর জন্য সুষ্ঠু ও সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে না পারি।

আমাদের নৈতিকতা এতই নিচে নেমে গেছে যে, আমরা দু'দিন যেতে না যেতেই আমাদের সন্তানদের জীবনের এই বিপর্যয়ের কথা ভুলে যাই। এসবের যেন কোনো প্রতিকার নেই। কোনো আইন নেই। দু'দিন পরেই হয়তো অন্য কোনো খবরের কারণে এই ঘটনাটিও সম্পূর্ণভাবে আমাদের বিস্মরণে চলে যাবে। এসব ঘটনা আর আমাদের তেমনভাবে আলোড়িত করবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা চলছে, আমরা অনেকেই অনেক কথা বলব; কিন্তু এসবের কোনো ফলাফল কি আসবে?

প্রতিকারহীন এই নির্লিপ্ততার কারণেই অরিত্রির আত্মহত্যা, যা সামাজিক বিশৃঙ্খলারই অনুষঙ্গ বলে মনে করি। আমাদের আরও বেশি সজাগ ও সচেতন হতে হবে। সংবেদনশীল হতে হবে। অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। স্বভাব ও আচরণে সৌজন্যবোধের প্রকাশ থাকতে হবে। সুস্থ-স্বাভাবিক ও সুন্দর মানুষ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। 

আমাদের পরস্পরের মধ্যে ক্রমাগত দূরত্ব তৈরি করছি, একে অপরের বিরুদ্ধে দেয়ালের পর দেয়াল তুলছি আমরা। তাই যে কোনো পরিস্থিতিতে কাউকে অপমান করতে বিন্দুমাত্র বাধে না আমাদের। দূরত্ব কমিয়ে আমরা একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সূত্রে বাস করার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে হয়তো এ ধরনের বিপর্যয় ঠেকাতে পারি। মানুষ সে জন্যই সমাজবদ্ধ হয়। সেখানে আমাদের সবারই দায় রয়েছে। 

 

লেখক :মানবাধিকার নেত্রী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

 

সূত্র: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027599334716797