আমার স্কুল, আমার বাগান

মাছুম বিল্লাহ |

বিদ্যালয় মানে শুধু পাঠ্যপুস্তক, পড়ালেখা, পরীক্ষা, গ্রেড আর সার্টিফিকেট অর্জন করা? বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীরা তো বাসায় কিংবা কোচিং কিংবা অন্য পরিবেশেও বই পড়তে পারেন, কিন্তু বিদ্যালয়ে কেনো? শেখার আনন্দই এখানে মুখ্য। যদিও আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে সেই আনন্দ অনেকটাই ফিকে। বিদ্যালয় যে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশেও ভূমিকা পালন করে থাকে, তা-ও এখানে গুরুত্বহীন হয়ে থাকে।

বিদ্যালয় হবে আনন্দালয়, শুধু কংক্রিটের ভবন নয়। এমন ভাবনা প্রয়োগে প্রয়োজন সৃজনশীল মানসিকতা ও সদিচ্ছা। সেটিই যেনো দেখা গেলো মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসনের এক উদ্যোগে। জেলাটির স্কুলগুলোকে ফুলের বাগানে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। বিষয়টি বেশ আশাব্যঞ্জক। মুন্সিগঞ্জ জেলায় প্রাথমিক বিদালয়ের সংখ্যা ৬১০ ও উচ্চবিদ্যালয় ১২৭। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে দৃষ্টিনন্দন বাগান করার পরিকল্পনা নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ উদ্যোগের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আমার স্কুল, আমার বাগান’। প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রায় দুই শতাংশ জায়গায় এ বাগান করা হবে। বিদ্যালয়ের ক্রীড়া তহবিলের আর্থিক সহযোগিতায় এসব বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব বাগানে সারা বছর ফুল, ওষধি গাছসহ শাকসবজির চারা লাগানো হবে। ইতোমধ্যে এ পরিকল্পনার বাস্তবায়নও শুরু করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলার দশটি বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত জায়গা ও বিদ্যালয়ের আঙিনায় বাগান করার কথা আমরা জেনেছি। এ সংখ্যা আরো বাড়ছে।

শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে বেশি সময় কাটান। বিদ্যালয়ে তাদের সবচেয়ে আনন্দের জায়গা। এখান থেকে তারা জীবন গড়তে শেখেন। বাগানের এ উদ্যোগ থেকে গাছের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বন্ধন গড়ে উঠবে। তাদের এ বন্ধন সারা জীবন থেকে যাবে। ফুলের বাগানের কারণে বিদ্যালয়গুলোর চেহারা ইতোমধ্যে পাল্টে গেছে। বাগানগুলোতে গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া, মোরগ ফুল, জিনিয়া, পানিকা, ক্রিসমাসট্রি, স্পাইডার, বনসাইসহ দেশি-বিদেশি জাতের কয়েক শ’ গাছ লাগানো হয়েছে। প্রতিটি গাছের পাশে ছোট করে নাম লেখা দেখা গেছে। বাগানে গাছের চারা ও ফুল শিক্ষার্থীরাই পরিচর্যা করছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন গাছ চিনছে, প্রজাতিগুলো সম্পর্কে জানছে, প্রকৃতিকে বুঝতে শিখছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ফুলের বাগানের এ পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে মহতী উদ্যোগ। এর জন্য জেলা প্রশাসন ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু বর্তমান ডিসি বদলি হয়ে গেলে পুরো বিষয়টি যাতে গুরুত্বহীন না হয়ে পড়ে সেদিকে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি রাখার অনুরোধ করছি। 

এ ধরনের অনেক মহৎ উদ্যোগের কথা আমরা জানি। যিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন তার অনুপস্থিতিতে এ ধরনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আমরা গাইবন্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম স্যারের কথা জানি। যিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে প্রায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দিয়েছিলেন।

সেখানে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসেন, থাকেন অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের মতো হোস্টেলে। দেশের বাইরে থেকে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসকরা দেখতে আসতেন তার সেই বিদ্যালয়। আমারও দেখার সুযোগ হয়েছে সুন্দরগঞ্জের সেই নামকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, নূরুল ইসলাম স্যার অবসরে গিয়েছেন, আর তার পর থেকে বিদ্যালয়টির কর্মকাণ্ড খেই হারিয়েছে। নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সেই আগের কলরব, অ্যাসেম্বলি, বিভিন্ন ক্লাব অ্যাক্টিভিটি। তিনি নেই, বিদালয়টি অবহেলায় পড়ে আছে। 

একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কীভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্যে রূপ দেয়া যায় সেই উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম। শিক্ষার্থীদের জন্য পাহাড়, ঝর্ণা, ভুগোল ল্যাব, সায়েন্স ল্যাব, নিয়মিত শারীরিক কসরত, বড় বড় হোস্টেল তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অবসরে যাওয়ার পর বিদ্যায়টির করুণ হাল হয়েছে। পাতা, লতা পড়ে পুরো ক্যাম্পাস ময়লা হয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের সেসব কার্যাবলিতে নেই কোনো প্রাণের ছোঁয়া, আনন্দের ছোঁয়া। মুন্সিগঞ্জের উদ্যোগের কথা শুনে খুব ভালো লেগেছে, সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরগঞ্জের নামকরা বিদ্যালয়টির বর্তমান হালও চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।

রংপুরের এক অধ্যক্ষের কথা জানি, যিনি সেনাবাহিনীর আর্টিলারি অফিসার। তাকে অধ্যক্ষ করা হলো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। কতো সৃজনশীলতা, কতো কমনীয়তা, কতো নিষ্ঠা থাকলে একজন শিক্ষক সব শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে পারেন। ছোট ছোট শিশুরা তাকে আটকে রেখেছিলেন, যেতো দেবেন না, যখন তার বদলির নির্দেশ এলো। শিক্ষার্থীরা সামরিক পোশাক পরা মানুষ দেখলে ভয় পাওয়ার কথা। অথচ তারা তাকে জড়িয়ে বলছেন, ‘আমরা তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না’। 

সেই সেনা অফিসার পুরো বিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ শুধু নয়, প্রতিটি শিশু, অভিভাবক, শিক্ষকের হৃদয় এমনভাবে জয় করেছিলেন যা আমাদের অনেকের জন্য বড় শিক্ষণীয়। 

সবশেষে বলতে চাই, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক যে উদ্যোগটি নিয়েছেন সেটি নেয়ার কথা ছিলো মূলত উপজেলা প্রাথমিক ও উপজেলা মাধ্যমিক অফিসারদের। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, কোনো উপজেলা প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমকি, জেলা প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব, যুক্তি কিংবা উদ্যোগ দেখিনি। 

 

 

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024552345275879