আমার অপরাধ আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কন্যা

ডা. জাকিয়া নূর লিপি |

আব্বা নেই আজ সাতচল্লিশ বছর। সেই শৈশবে আব্বাকে হারিয়েছি। তাঁর আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমিসহ আমার অন্য ভাই-বোনেরা। আমাদের কী অপরাধ ছিলো? যে কারণে আমাদের প্রিয় বাবাকে হারাতে হয়েছে? কী অপরাধ ছিলো আমার বাবার? যে কারণে তাঁকে মধ্যরাতে কারাগারের মতো নিরাপদ স্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো?

আব্বার অপরাধ তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগত ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁর অপরাধ তিনি একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁর অপরাধ তিনি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ বারবার আহবান সত্ত্বেও তিনি খুনি মোস্তাকের সাথে হাত মেলাননি। বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেঈমানি করে পচাঁত্তর পরবর্তী সরকারে যোগ দেননি। মোস্তাক অনেক চেষ্টা করেছে, টেলিফোন করে বাবাকে ভয় দেখিয়েছে। প্রতিউত্তরে আব্বা তার ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

বেহায়া মোস্তাক এরপর আম্মার সাথে যোগযোগ করে বাবাকে বোঝানোর কথা বলে। কিন্তু আমার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন অবিচল। সামান্য ক্ষমতার লোভে কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের সাথে হাত মিলাননি। বিনিময়ে তাঁকে প্রাণ দিতে হলো। ভয়ংকর এক মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হলো। খুনি চক্রের সাথে হাত না মেলানোয় পরিণতি কী হতে পারে আব্বা তা জানতেন, তবুও প্রিয় নেতার রক্তের সাথে তিনি বেঈমানি করেননি।

বঙ্গবন্ধুর সাথে আব্বার প্রায় তিন দশকের বন্ধুত্ব। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের প্রাক্কালে সিলেট থেকে পরিচয়। তারপর বাংলার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে তাঁরা একসঙ্গে হেঁটেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। পাকিস্তানি জান্তা সরকারের রক্তচক্ষুকে ভয় না করে দৃঢ চিত্তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগ্রাম করেছেন। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা আব্বাকে ‘সঙ্কট-মানব’ হিসেবে উল্লেখ করে। ‘সঙ্কট-মানব সৈয়দ নজরুল’ শিরোনামে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে পত্রিকাটি বলে- ‘স্বাধীন-বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কর্ণধার সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাঙ্গালিদের কাছে একজন সঙ্কট-মানব হিসেবে পরিচিত। বস্তুতঃ আওয়ামী লীগ ও বাঙ্গালি যখনই কোন সঙ্কটে পতিত হয়েছে তখনই তাঁর উপর অর্পিত হয়েছে পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব। সহজ সরল নীতিনিষ্ঠ এই মানুষটি কথার চেয়ে কাজ করেন বেশি-চিন্তা করেন আরও বেশি।’ 

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী সৈয়দা নাফিসা ইসলামের পাশে পুত্র ড. সৈয়দ শরিফুল ইসলাম, কন্যা সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি ও রাফিয়া নূর রূপা

সেই আব্বাকে হারিয়ে আমরা দিকহারা। অনিশ্চয়তায় কেটেছে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত। রাতের পর রাত কেটেছে নির্ঘুম। আমার সহজ-সরল মায়ের উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পরিচিত মানুষসব চোখের পলকে বদলে গেলো। এই সেদিনও কত মানুষ সাহায্য- সহযোগিতা পাওয়ার আশায় আব্বার চারপাশ ঘিরে রেখেছেন। মুহূর্তেই যেনো সব পালটে গেলো। মিন্টু রোডের সরকারি বাড়ি ছাড়তে হলো। থাকার জন্য একটি নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা ভয়াবহ বিষয় হয়ে দাঁড়ালো আমাদের জন্য। একটি সুখী সুন্দর পরিবার মুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেলো। কাঁচের মতো ভেঙ্গে পড়লো আমাদের স্বপ্নগুলো। অনিশ্চিত হয়ে পড়লো আমাদের শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু। 

এই অবস্থায় আম্মা সৈয়দা নাফিজা ইসলাম তাঁর বিধ্বস্ত মনকে শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন প্রিয় সন্তানদের ভবিষ্যৎতের কথা চিন্তা করে। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আব্বা যখন মুক্তিযুদ্ধের সরকার পরিচালনা করছেন, আমরা তখন পাকিস্তান সরকারের ঘোষণা করা মৃত্যুর হুলিয়া নিয়ে দেশের ভেতর এখানে-ওখানে আতংকের দিন-রাত পার করছি। আম্মা তখন পরম মমতায়, যত্নে আমাদের আগলে রেখেছিলেন। একাত্তরের সেই সাহসী রূপ তখন আম্মার মুখচ্ছবিতে। গ্রামের ঋজু সেই নারী যদি সেদিন শক্ত হাতে হাল না ধরতেন তাহলে আমাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াটাই নিশ্চিত ছিল।

ধীরে ধীরে আমরা বড় হয়ে ওঠছি। বড়ো দুই ভাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মঞ্জুরুল ইসলাম বিদেশে। দেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত সাফায়েতুল ইসলাম ভাই। ছোট ভাই শরিফুল ইসলাম, আমি আর রুপা পড়ছি। আমি ভর্তি হলাম ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। লেখা-পড়া শেষ করে একটি চাকরির জন্য যেখানেই আবেদন করেছি সেখান থেকেই প্রত্যাখাত হয়েছি। তারা সিভি দেখে যখনই নিশ্চিত হয়েছে আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামে কন্যা তখনই আমাকে না করে দিয়েছে। আমার অপরাধ আমি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কন্যা। তখন ১৯৯১-৯২ খ্রিষ্টাব্দ। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণে কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয় স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এখনও সক্রিয় এখানে-ওখানে। তাদেরকে প্রতিরোধ করতে হবে। আজকের এই শোকের দিনে এই হোক দৃপ্ত শপথ।

ডা. জাকিয়া নূর লিপি : সংসদ সদস্য, কিশোরগঞ্জ- ১ (সদর-হোসেনপুর)


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024271011352539