শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে পরীক্ষার চাপ কমানোর কথা চলে আসছিল বেশ আগে থেকেই। এবার সে চাপ কমে গেল। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত আর কোন পরীক্ষা থাকছে না। জাতীয় শিক্ষা নীতিতেও প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে এখন যেভাবে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে সেভাবে না নেয়ার কথা রয়েছে। এবার সেটা আরও এক ক্লাস এগিয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায়। ভালো হলো। আরও ভালো হবে যদি পঞ্চম শ্রেণী থেকে পিইসি পরীক্ষাটা তুলে দেয়া হয়। পঞ্চম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা রেখে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দিলে শিশুদের নতুন করে আবার পরীক্ষাভীতির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। কারণ চতুর্থ শ্রেণীতে গিয়ে তারা প্রথম প্রশ্নপত্র হাতে পাবে এবং খাতা-কলমে পরীক্ষা দিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবে। তারপর পঞ্চম শ্রেণীতেই পাবলিক পরীক্ষা। তার মানে স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে একবার শুধু পরীক্ষায় বসেই তারা পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। অভিভাবক-শিক্ষক কারও জন্য সেটা স্বস্তিকর হবে না।
সুযোগ সন্ধানীরা উল্টা তখন এখনকার মতো ফায়দা নিতে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। বৃত্তি প্রদানের জন্য সমাপনী পরীক্ষাই একমাত্র উত্তম ব্যবস্থা এমন ভাবার কোন কারণ নেই। পরিবর্তন আনতে চাইলে আরও উন্নত পদ্ধতি যে পাওয়া যাবে না এমনও মনে করার কোন কারণ নেই। সে আলোচনা ভিন্ন প্রসঙ্গ। জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা বলে কথা। জিপিএ-৫, গোল্ডেন না পেলে জীবন বরবাদ-এমন প্রচার তো আছেই বাজারে। এবং সেটা এমনই যে মনে হয় যেন ওদের ঘুম দরকার নেই খেলাধুলা দরকার নেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের দরকার নেই পারিবারিক মেলামেশা হৈচৈর দরকার নেই জিপিএ-৫, গোল্ডেন হলেই চলবে। অভিভাবকরা নিরুপায়। চাপে পড়ে বেশিরভাগ অভিভাবক খেয়ে না খেয়ে জোগাচ্ছেন টাকা, সন্তানেরা একদিন মানুষ হবে এ আশায়। আর এ মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে চলে আসছে শিশুদের শিক্ষা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য। এর থেকে বেরিয়ে আসতেই আজ তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা উঠে যাচ্ছে। তাই বলতে চাচ্ছি এর সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণী থেকে পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। এতে পুরো ব্যাপারটা টেকসই হবে এবং লেখাপড়া শ্রেণীকক্ষমুখী হবে। ছাত্রছাত্রীদের ভেতর নিজে পড়ার মনোভাবও গড়ে ওঠবে। কেবল পরীক্ষা পরীক্ষা করে ছুটতে হবে না।
আরও একটা বিষয় আছে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দুবছর করার কথা উঠেছে। এটা করা হলে এখানে দুই বছর আর তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত তিন বছর মোট ৫ বছর শিশুরা পরীক্ষা ছাড়া পার করতে পারবে এটা খুব আনন্দের হবে এবং বিভিন্নমুখী মেধা বিকাশেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। পরীক্ষা থাকবেÑ থাকবে না কেন। যেমন তুমি পড়ো তো দেখি এক মিনিটে কয়টা শব্দ পড়তে পার। তারপর তুমি তারপর তুমি বলো। এটাও তো পরীক্ষা, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। এ অঙ্কটা বোর্ডে গিয়ে করে দেখাও। কে কে পারল কে কে পারল না এটাও তো পরীক্ষা হলো। শ্রেণীকক্ষেই চলবে ওদের নিত্য পরীক্ষা। পরিবর্তন যেটা হবে তা হলো মতাবান কেউ এককভাবে অথবা কতিপয় শিক্ষক মিলে প্রশ্নপত্র তৈরি করে প্রেস থেকে ছাপিয়ে এনে পরীক্ষা নিতে পারবে না। আমরা একে স্বাগত জানাই।
সরকারি প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া হয় না এ কথাটা বেশ আগে থেকেই ভালোভাবে চালু হয়েছে সমাজে। যারা ছোটদের লেখাপড়া নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে তারা সুকৌশলে এ কাজটা করে নিয়েছে আগে। তারা সহজেই কাজটা করতে পেরেছে কারণ কথাটা কতখানি সঠিক তা একবার কেউ মাঠে নেমে জরিপ করে দেখেছেন এমন শোনা যায়নি। গ্রামের কথায় বলি সরকারি স্কুলের আশপাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন নামের স্কুল। নানা রকম মাদরাসা তো আছেই। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নিশ্চয় সেগুলো গড়ে উঠেনি। সেখানে যে কী পড়ায় কী শেখায় কতটুকু সময় পড়ায় পরীক্ষা কত বার নেয় সহায়ক বইয়ের নামে কত বই-খাতা কেনায় তা দেখার কেউ নেই। কারিকুলামের বাইরে কোন বই স্কুলে পড়ানো যাবে না এ কথা বলে দিয়েই এনসিটিবির দায়িত্ব শেষ। তাদের ভাষ্যÑ তাদের সে জনবল নেই।
এসব প্রশাসনের দায়িত্ব। নজরদারি না থাকলে এমন তো হতেই পারে। সে যা হোক, সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের থেকে ভালো মানের শিক্ষকরা ওই সব কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ান এটা বিশ্বাস করার কোন কারণ দেখি না। শহরে জিনিসটা আরও প্রকটভাবে চোখে পড়ে। আর গ্রাম হোক শহর হোক বড় হোক ছোট হোক সবখানের একই অবস্থা। যে অভিভাবকের একটু আর্থিক সঙ্গতি আছে সে আর তার সন্তানকে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। কথাটার বেশি ব্যাখ্যা করতে গেলে নিজেরই ভালো লাগবে না। এমনও শোনা যায় শহরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দুটা হাজিরা খাতা সংরক্ষণ করা হয়। একটা থাকে আসল আরেকটা থাকে দুই নম্বর। কর্তৃপক্ষের সামনে যেটা হাজির করা হয় প্রয়োজনে সেটা দুই নম্বর। আসল চিত্র কর্তৃপক্ষের সামনে তুলে ধরলে অনেক শিক্ষকের চাকরি না গেলেও ওই স্কুল ছাড়তে হবে ছাত্র স্বল্পতার কারণে। অন্য শ্রেণীর কথা বাদ দিলাম গতবার পিইসি পরীক্ষায় প্রথম দিনই দেড় লাখ ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত ছিল এর কি কোন কারণ খুঁজে দেখা হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যে এসব জ্ঞাত নয় তা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। সে কথায় আর নাই গেলাম। তবে যে কথাটা এ প্রসঙ্গে আসে তাহলো, সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরাও কেউ সরকারি প্রাইমারিতে পড়ে না। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলা যাবে না। আমিও বলছি না। তবে অবস্থা এ রকমই। আজ এসব কোন কথারই প্রয়োজন হতো না যদি না বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠতো। প্রধামন্ত্রীকেও এ কথা বলতে হতো না যে, তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না। এখন একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, লেখাপড়াকে কঠিন ভাবে শিশুদের সামনে তুলে ধরায় আজ লেখাপড়ার মান পড়ে গেছে এ কথা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। যা হোক সেটাও ভিন্ন প্রসঙ্গ।
একটা চারা গাছের কান্ড যদি একবার বাকা হয়ে জন্মে যায় তবে তাকে আর সোজা করা যায় না একবারে উপড়ে ফেলা ছাড়া। শিশুদের কোন নিজস্বতা নেই। পৃথিবীর সব মানবশিশুর চরিত্রই এক। কোন ভাষা কালচার শিখে কেউ জন্মে না জন্মেই শেখে। শেখাতেও হয়। প্রথমে শেখে তারা পরিবার থেকে তারপর শিক্ষার সহজ রাস্তাটা ধরিয়ে দেয়া হলো শিক্ষকের কাজ। শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তবে শিক্ষক হলো গোটা জাতির সভ্যতার সত্তা। তারাই সে কাজ করে এসেছে তারাই পারবে। প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগান দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে তাদের ওপর।
এখন কী হচ্ছে চারদিকে শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। ভর্তির জন্য পরীক্ষা পাসের জন্য পরীক্ষা আর এর জন্য প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষার কোন অন্ত নেই। পরীক্ষার যন্ত্রণায় সবাই অস্থির। পত্রিকাওয়ালারাও দেখা যায় সাজেশন তৈরি করে দিতে ব্যস্ত। গাইডওয়ালারা তো প্রাণান্তকর। মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করে তারা বিশেষজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। যে কথাটা বলতে চাচ্ছি, সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছে অনেকে বলেন পাবলিক পরীক্ষা বেশি হওয়ার কারণে যেমন পঞ্চম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা তিন ক্লাস পরে অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষা (জেএসসি) তার দুই ক্লাস পরে দশম শ্রেণীতে এসএসসি পরীক্ষা তার দুই ক্লাস পরে এইচএসসি পরীক্ষা। অর্থাৎ ১২ ক্লাস পর্যন্ত পড়তে একজনকে দিতে হচ্ছে চারটা পাবলিক পরীক্ষা। আর এই চার পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বয়ে যাচ্ছে পরীক্ষার বন্যা চারদিকে। এর বাস্তবতা হলো পরীক্ষা যত বেশি বেশি হচ্ছে লেখাপড়ার মান তত বেশি পড়ে যাচ্ছে। মান যদি এ রকম পড়েই যেতে থাকে তাহলে আর এত পরীক্ষা কেন। আবারও বলি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা বাদ দেয়ার উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। এর সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণী থেকে পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে এ আশা আমরা করতে পারি।
সৌজন্যে: দৈনিক সংবাদ