দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: বর্তমানে দেশে মোট বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৬৭টি। এর মধ্যে এ বছর এমবিবিএস কোর্সে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আসন রয়েছে ৬ হাজার ২৯৩টি। ভর্তি শেষ হয়েছে গত ১৮ এপ্রিল। কিন্তু এখনো ৮৭ শতাংশ কলেজেই আসন ফাঁকা রয়েছে। অর্থাৎ সরকার বরাদ্দকৃত নির্দিষ্টসংখ্যক আসনগুলোতে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী পায়নি ৫৮টি কলেজ। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) ও বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সের এ চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, এ বছর এখনো আসন অনুযায়ী শতভাগ শিক্ষার্থী পেয়েছে ৯টি কলেজ। ১-৮টি পর্যন্ত আসন ফাঁকা রয়েছে এমন কলেজের সংখ্যা ১০টি। এমনকি ১২টি কলেজে আসন ফাঁকা রয়েছে মোট আসনের ৮২-২৪ শতাংশ পর্যন্ত। বাকি কলেজগুলোতে ফাঁকা রয়েছে ১-১৯ শতাংশ পর্যন্ত আসন।
এমনকি এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। এখনো ফাঁকা রয়েছে তাদের জন্য বরাদ্দ আসনের ৩৫ শতাংশ।
রাজধানীর একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, আমাদের ৬০ আসন। এখন পর্যন্ত অর্ধেকের মতো পূরণ হয়েছে। এর মধ্যে আবার কয়েকজন ১ লাখ টাকা করে দিয়ে আরো ভর্তি হচ্ছে না। আমরা এখন খুব হতাশার মধ্যে আছি। এমনকি বিদেশি আসনের অর্ধেকও পূরণ হয়নি। ২৭টি আসন বিদেশিদের জন্য।
এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থী সংকট কাটাতে পুনরায় ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ১৯ মে থেকে তিন সপ্তাহের জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তির আবেদনের পোর্টাল আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। আরো দেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ২১ মে থেকে ৮ জুন পর্যন্ত পুনরায় ভর্তির আবেদন করতে বলা হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে ২৭ জুন থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত ভর্তি চলবে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থী সংকটের পেছনে কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও কর্মকর্তারা মোটা দাগের চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো বিদেশের বিভিন্ন দেশে কম খরচে পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টি, দেশের ভেতর অটোমেশন পদ্ধতি, ব্যয় সংকুলান করতে না পারায় মধ্যবিত্ত মেধাবী শ্রেণির অনীহা ও অধিদপ্তরের অদক্ষতা।
অবশ্য শিক্ষার্থী সংকটের পেছনে ভিন্ন কারণ দেখছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা। তিনি বলেন, আমরা আবার নতুন করে ভর্তির সুযোগ দিয়েছি। আরো ভর্তি হতে পারবে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২০০টি আসন রয়েছে। এসব আসনে শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি। এ আসনগুলো ফাঁকা থাকবে। বেসরকারি পর্যায়ে গতবারও ৪০০-৫০০ আসন খালি ছিলো। এবার বিদেশি শিক্ষার্থী কম এসেছে। আমরা বিদেশিদের শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য নতুন করে পোর্টাল খুলে দিয়েছি। এটা খুলে দেওয়ার কথা ছিলো না।
এ কর্মকর্তা আরো বলেন, তারা (বেসরকারি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ) সে পরিসংখ্যান দেখিয়েছে, সেটা ঠিক নয়। আমরা হিসাব করে দেখেছি ৪০০-৫০০ আসন খালি আছে। সেটাও নতুন ভর্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং তাদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ ঠিক হয়নি।
অটোমেশন পদ্ধতির পক্ষে যুক্ত দেখিয়ে এ মহাপরিচালক বলেন, যার যেখানে ভর্তি হওয়ার দরকার, সে সেখানে ভর্তি হতে পারছে। বাড়তি টাকান্ডপয়সা লাগছে না। মেধায় যে পেছনে পড়ে আছে সে টাকা পয়সা বেশি দিয়ে একটি ভালো মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। সুতরাং এ পদ্ধতি সবারই সাধুবাদ জানানো উচিত।
এ কর্মকর্তা আরো বলেন, বৈশ্বয়িক কারণেই মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই খারাপ। মানুষের ব্যয় সংকুলানও কঠিন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া যে পরিমাণ ছাত্রছাত্রী ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, তাদের চেয়ে বেশি ভর্তি করানো যাবে না। যারা ৪০ মার্কস পেয়েছে তাদের সবাইকে আমরা ভর্তির সুযোগ দিয়েছি। তাদের মধ্যে সামর্থ্যবান শিক্ষার্থী এত বেশি না থাকে, সেটা তো পদ্ধতির দোষ না। আমরা কখনই একজন খারাপ শিক্ষার্থীকে চিকিৎসক বানাতে পারি না। টাকার বিনিময়ে যোগ্যতার সঙ্গে আপস করতে পারি না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭টি ও বেসররকারি মেডিকেল কলেজ ৬৭টি। সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৫ হাজার ৩৮০টি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আছে ৬ হাজার ২৯৫টি। মোট আসন ১১ হাজার ৬৭৫টি। এ বছর এসব কলেজে ভর্তির জন্য গত ৯ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা হয়। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ও প্রথম দফায় বেসরকারিতে ভর্তি শেষ হয় ৮ এপ্রিল।
৯ কলেজের শতভাগ আসন পূরণ : স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও বিপিএমসিএর ভর্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৬৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে এখন পর্যন্ত নয়টি কলেজের শতভাগ আসন পূরণ হয়েছে, যা মোট কলেজের ১৩ শতাংশ। বাকি ৮৭ শতাংশ কলেজেই আসন ফাঁকা রয়েছে। শতভাগ আসন পূরণ হওয়া কলেজগুলো হলো রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ, আদ-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ, গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রামের মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিকেল কলেজ, সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ ও টাঙ্গাইলের কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজ। এসব কলেজে১৫৫-৬৫ আসন রয়েছে।
এ ছাড়া মোট আসনের মধ্যে কমপক্ষে একটি থেকে সর্বোচ্চ আটটি পর্যন্ত আসন ফাঁকা রয়েছে ১০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের।
১১ কলেজে বেশি ফাঁকা : সর্বোচ্চ ৮২-২৪ শতাংশ পর্যন্ত আসন ফাঁকা রয়েছে, এমন কলেজের সংখ্যা ১০টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফাঁকা রয়েছে শরীয়তপুরের মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজের। এখানে মোট আসন ৫০টি। ভর্তি হয়েছেন ৯ জন শিক্ষার্থী। ফাঁকা রয়েছে ৪১টি আসন। এরপর সিটি মেডিকেল কলেজের ৬৬ শতাংশ, চট্টগ্রামের বি জি সি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের ৪০ শতাংশ করে, চট্টগ্রামের ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লাইড হেলথ সায়েন্সেস (আইএএইচএস) ৩৮ শতাংশ, কিশোরগঞ্জের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজের ৩৪ শতাংশ, রাজধানীর মার্কস মেডিকেল কলেজের ৩৩ শতাংশ, রাজধানীর সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজের ৩০ শতাংশ, নারায়ণগঞ্জের ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজের ২৮ শতাংশ, সিরাজগঞ্জের নর্থবেঙ্গল মেডিকেল কলেজের ২৬ শতাংশ, সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ ও রাজধানীর ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের ২৪ শতাংশ করে আসন ফাঁকা রয়েছে। বাকি কলেজগুলোতে ১৯-১০ শতাংশ পর্যন্ত আসন ফাঁকা রয়েছে।
অটোমেশনকে দুষলেন কলেজ কর্র্তৃপক্ষ : কয়েকটি কলেজের অধ্যক্ষ ও কর্মকর্তারা গতবারের মতো এবারও শিক্ষার্থী সংকটের পেছনে অটোমেশনকে দুষছেন। তারা জানান, আগে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো কলেজে স্বাধীনভাবে ভর্তি হতে পারতেন। নিজস্ব এলাকার কলেজে ভর্তি হতেন। কিন্তু অটোমেশন পদ্ধতির কারণে এবার সেটা হচ্ছে না।
দক্ষিণাঞ্চলের একটি নামকরা মেডিকেল কলেজের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের এখানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বান্দরবান, কক্সবাজার ও নাটোর থেকে শিক্ষার্থী দিয়েছিল। অথচ প্রতি বছর কাছাকাছি ফরিদপুর, যশোর, সাতক্ষীরার অনেক শিক্ষার্থী আসে। কিন্তু এবার অধিদপ্তর দূর-দূরান্তের শিক্ষার্থী দিয়েছে। তারা ভর্তি হয়নি। চলে গেছে। সরকার যদি এলাকাভিত্তিক ছাত্রছাত্রী দিত, তাহলে এ সমস্যা হতো না। ঢাকা ও খুলনা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা এখানে আবেদন করতে পারে। এরকম যদি হতো তাহলে এ সমস্যাটা হতো না। আমাদের এখানে কক্সবাজার, চট্টগ্রামের স্টুডেন্ট দিয়েছে। সেখানকার স্টুডেন্ট কি এখানে আসবে? আসবে না।
আরো যেসব কারণ : ঢাকার আশপাশে ও রাজধানীর কয়েকটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও কর্মকর্তারা জানান, এবার সব কলেজের একই অবস্থা। এগুলো অপরিণামদর্শিতার ফল। অব্যবস্থাপনা, অযোগ্যতা এসব কারণে এ অবস্থা। বৈদেশিক মুদ্রা কিছু অর্জন হতো। এবার সেটা থেকেও বঞ্চিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যক্ষ বলেন, সরকারি ও বেসরকারি ভর্তি সময়ের মধ্যে একটা ফারাক তৈরি হচ্ছে। সে কারণে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে ভর্তি হয় না। কারণ বেসরকারিতে পড়তে ইন্টার্নিসহ ২১ লাখ ২০ হাজার টাকা লাগবে। তারা ভাবে এত টাকা দিয়ে না পড়ে তারা সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা করবে। তাছাড়া সব পরিবার তো সচ্ছল না। এসব ভেবে তারা শেষ পর্যন্ত অন্য জায়গায় ভর্তি হয়ে যায়। আরো যদি সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হতে পারত, ক্লাস শুরু হয়ে যেত, তাহলে এ জিনিসগুলো হতো না।
তিনি আরো বলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য এত টাকা সেটা তো অবশ্যই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার ছেলে বা মেয়ে হলেও তো আমি দিতে পারতাম না।