আহমদ ছফার শিক্ষা-দর্শন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কখন একজন মানুষ কালকে জয় করেন, অথবা কখন তিনি অমর হয়ে ওঠেন? যতক্ষণ তিনি প্রাসঙ্গিক থাকেন ততক্ষণ, নাকি নিজের সময় ও সময়ের সংকটকে সঠিকভাবে অনুধাবন করে সেটাকে প্রকাশ করতে পারেন, তখন? উত্তর হলো দুটোই। আহমদ ছফা অমরত্ব লাভ করেছেন আজ অবধি প্রাসঙ্গিক থাকার কারণে তো বটেই, নিজের সময়কে সঠিকভাবে অনুধাবন করার কারণেও। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি সব বিষয়ে আহমদ ছফা যে দিবালোকের মতো স্পষ্ট বক্তব্য প্রজ্ঞার সঙ্গে হাজির করতে পেরেছিলেন, তার প্রধান কারণ ছিল তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন। চর্চার ভেতর দিয়ে জাতীয়তাবোধকে তিনি জাগ্রত রাখতে জানতেন। এ কারণেই চুম্বক খণ্ডে লৌহকণা ধরা পড়ার মতো নানা অসঙ্গতি, সংকট ও সমাধান তার কলমে ধরা পড়েছে উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ বা কলাম আকারে। রোববার (২৮ জুলাই) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন বিধান রিবেরু।

বাংলাদেশের অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন আহমদ ছফা। যে কোনো সুস্থ দেশপ্রেমিকেরই তা হওয়ার কথা। কিন্তু এক অদ্ভুত কারণে সেই উদ্বিগ্ন ভাব দেশের শাসক ও ধনিক শ্রেণির কাউকে স্পর্শ করেনি, করছে না। এই অদ্ভুত কারণটি আহমদ ছফা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি মনে করতেন, পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে যে মধ্যশ্রেণি ক্ষমতায় বসেছিল, "জাতির আর্থিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক জীবন এবং মননশীলতার ধারাকে একটা সুষ্ঠু মঙ্গলজনক খাতে প্রবাহিত করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। তাদের জাতীয়তাবোধটিও ছিল 'দোদুল্যমান'।"

এই দোদুল্যমান মানসিকতা পরবর্তীকালে আরও নড়বড়ে হওয়ার কারণে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে, ভাষা আন্দোলনের যে অঙ্গীকার অর্থাৎ জাতীয় অঙ্গীকারও হয়েছে পদদলিত। আহমদ ছফা মনে করতেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পাঠ্যপুস্তক এই তিন অপরিহার্য জিনিসের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিচারশীল ও চিন্তাশীল করে তুলতে না পারলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ভণ্ডুল হয়ে যায়। বিচারশীল ও চিন্তাশীল করে তোলার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। তাই বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে বাংলা, কিন্তু ছত্রাকের মতো ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যায়তনের বিস্তার দেখে আহমদ ছফা শুধু ব্যথিতই হননি, বিরক্তও হয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'ইংরেজরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেয় নিল, আর হুড়হুড় করে ব্যাঙের ছাতার মতো ইংরেজি স্কুলের সংখ্যা বাড়তে থাকল। এই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল আইয়ুব খানের রাজত্বের মাঝামাঝি থেকে। সেই সময়ে বাংলাদেশে যে মধ্যশ্রেণিটি তৈরি হয়েছিল, তারা ছেলেমেয়েকে ইংরেজির মাধ্যমে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়াটাকে সামাজিক মর্যাদার একটা প্রতীক বলে মনে করত।'

এখন উচ্চ থেকে শুরু করে নিম্নমধ্যবিত্ত সব শ্রেণির মানুষই মনে করে ইংরেজি না জানলে চাকরি পাওয়া কঠিন হবে, মর্যাদাও থাকবে না নিশ্চিত। কিন্তু কেউ ভাবছে না যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাষা শিখলেই কেউ ব্রিটিশ বা মার্কিন নাগরিক হয়ে যায় না। তারা বাংলাদেশিই থাকবেন। দেশি মুখ, বিদেশি মুখোশ নিয়ে আদতে একটি জাতি কতদূর যেতে পারে? আজকাল তো ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসারও বেশ প্রসার হয়েছে দেশে। পশ্চিমা সেসব শিক্ষা আদৌ দেশের কোনো কাজে আসে কি-না সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ছফা। তিনি মনে করেন, বিদেশি বিদ্যার ভারবাহী পশু হয়ে দেশের কোনো উন্নতি সাধন হয় না। তাই বলে এটা ভাবার অবকাশ নেই তিনি পশ্চিমা জ্ঞানের বিপক্ষে।

ছফা বলতে চান, যে জ্ঞানের বলে বিদেশিরা সাফল্য লাভ করেছে, সে জ্ঞান, যে কোনো মূল্যে, বাংলা ভাষায় নিয়ে আসতে হবে। নিজের ভাষায় মানুষ যেন গবেষণা করতে পারে সেরকম ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। জ্ঞানের সামাজিকীকরণে এর কোনো বিকল্প নেই। অথচ ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষার প্রতি প্রেম দেখিয়েই চলেছে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ বা ইংরেজিতে সিভিল সোসাইটি। জাতির সঙ্গে এমন বেইমানি আচরণে ক্ষুব্ধ ছফা তাই বলতেন, 'আজ এই দাস্য মনোভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা নইলে আমাদের স্বাধীনতা মিথ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু এই মানসিক দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাজটা হৈ হৈ করে হওয়ার কথা নয়। এতে প্রয়োজন সুন্দরতম ধৈর্য, মহত্তম সাহস, তীক্ষষ্টতম মেধা এবং প্রচণ্ড কূলছাপানো ভালোবাসা, যার স্পর্শে আমাদের জনগণের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগবে এবং সাহস ফণা মেলবে।'

কূলছাপানো ভালোবাসা থেকেই ছফা নিজে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। নানা তৎপরতার ভেতর আমি মনে করি শিক্ষা নিয়ে ভাবনা ও এর জন্য কাজ করা ছিল আহমদ ছফার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। শিক্ষার মাধ্যমেই একটি জাতি, ভিন্ন নামে যদি ডাকেন, তাহলে একটি রাষ্ট্র সত্যিকার অর্থেই উন্নতি সাধন করে। জাতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে সম্পর্কিত করে ভাবতে পারতেন বলেই আহমদ ছফা বড় লেখক হয়ে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন। সলিমুল্লাহ খান তার প্রসঙ্গেই বলেছিলেন, 'বড় চিন্তাই বড় লেখকের জননী।'


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029900074005127