ইংরেজির মারপ্যাঁচে পুরো শিক্ষাজীবন

জুবায়ের হোসাইন |

মাত্র তিন মাসের স্পোকেন কোর্স করে যদি ছেলেমেয়েরা অনর্গল ইংরেজি বলতে পারেন, তাহলে ১২ বছরে আমরা কী শেখাচ্ছি? তারা ইংরেজি বলতে পারছেন না কেনো? এটা তাদের কাছে দুর্বোধ্যই কেনো থাকছে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

চলতি বছরের গত ৩০ জুলাই ‘ফিউচার অব এডুকেশন অ্যান্ড ওয়ার্ক: স্টেপিং স্টোন টুওয়ার্ডস স্মার্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক ‘ফায়ার সাইট চ্যাটে’ তিনি এসব কথা বলেন। শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমরা যে খুব ভালো বাংলা বলছি, তাও নয়। ইংরেজির কথা যদি ধরি, আমরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে, অর্থাৎ ১২ বছর ধরে ইংরেজি শেখাচ্ছি। অথচ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা কতটা ইংরেজিতে একটু স্বস্তির জায়গায় আছে। চাইলেই যে কোনো জায়গায় নিজের মনের ভাবটা প্রকাশ করার মতো জায়গায় আছে কতোজন?

এর আগে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অধীন ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন মাত্র দুই জন শিক্ষার্থী। অথচ সেই ইউনিট থেকে বিভাগটিতে ১২৫ জন শিক্ষার্থীর ভর্তি হওয়ার কথা ছিলো। 

এ ধরনের খবর দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোতে খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়। এতে দেশের চলমান ইংরেজি শিক্ষা পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আসুক আর না আসুক, অন্তত দেশের শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে দুর্বলতার ভয়াবহ চিত্রটি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। 

এখন প্রশ্ন ওঠে, এই যে শিক্ষার্থীদের পুরো শিক্ষাজীবন জুড়ে বছরের পর বছর ধরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আমরা ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা করে আসছি, তা আসলে কতোটা ফলপ্রসূ হচ্ছে? 
ব্রিটিশ রাজত্বের মতো ইংরেজি এখন আর সরকারি ভাষা না হলেও বর্তমান বাংলাদেশ সরকার দেশে ও বিদেশে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে একে শিক্ষার দ্বিতীয় মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাঠ্য হিসেবে ইংরেজি এখন অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখানো হয় এবং প্রায় সব পাবলিক পরীক্ষায় এটি একটি আবশ্যিক বিষয়।  

ক্লাস ওয়ান থেকে এইচএসসি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসেই বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে ইংরেজি পড়ানো হয়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে পড়াকালীন দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী টানা বারোটি বছর ধরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় ও অর্থ ব্যয় করেন শুধু ইংরেজি শেখার পেছনে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার পাশাপাশি বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আলাদা করে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে অথবা কোচিং সেন্টারে গিয়েও ইংরেজি পড়ে থাকে। 

স্কুল-কলেজে এতো এতো ইংরেজি শিখেও এইচএসসি পাস করে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যায়, তখন শিক্ষার্থীদেরকে মুখোমুখি হতে হয় ভিন্নরকম ‘ইংরেজি’র। কেনোনা স্কুল-কলেজে যে সিলেবাসে তারা ইংরেজি শিখে আসে, ভর্তি পরীক্ষায় আসা ইংরেজি প্রশ্ন সমাধানে তা খুব একটা কাজে আসে না। তাই নতুন করে আবার ‘বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং’ এ ভর্তি হতে হয়। 

বিগত কয়েক বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী ফেল করে ইংরেজিতে। শুধু ফেল নয়, এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই ভর্তি পরীক্ষায় ১ বা ২ নম্বর পায়। 
শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিষয়ে ভাল নম্বর পেলেও শুধু ইংরেজিতে ফেল করার কারণে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ব্যর্থ হচ্ছেন। প্রাথমিক থেকে এইচএসসি পর্যন্ত শত শত নম্বরের ইংরেজি পরীক্ষায় পাস করে এসেও শিক্ষার্থীদের এমন বেহাল দশা সত্যিকার অর্থেই উদ্বেগজনক। 

ইংরেজি নিয়ে ভোগান্তি এখানেই শেষ নয়। বর্তমানে দেশের প্রায় সবকটি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজির ব্যবহার বেশি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসগুলোর অধিকাংশ যেমন ইংরেজিতে পরিচালনা করা হয়, তেমনি পরীক্ষার প্রশ্নও করা হয় ইংরেজিতে এবং শিক্ষার্থীদের উত্তরও লিখতে হয় ইংরেজিতে। এ ছাড়া রয়েছে অ্যাসাইনমেন্ট-প্রেজেন্টেশনসহ নানান রকমের মূল্যায়ন পদ্ধতি, যার সবই কি না ইংরেজি-নির্ভর। 

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব পাঠ্যবই পড়ানো হচ্ছে, তার প্রায় সবই ইংরেজিতে লেখা। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পড়ে বুঝতে পারছে না, উল্টো না বুঝে মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাস করার প্রবণতা বেড়েছে, যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে শিক্ষা পরবর্তী জীবনে। 

বর্তমানে সব ডিগ্রি কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রথম-বর্ষে বাধ্যতামূলক একটি ইংরেজি কোর্স চালু হয়েছে। এখানেও শিক্ষার্থীদের ফেলের হার লক্ষণীয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে চাকরির পরীক্ষায়ও বহুবছর ধরে শিক্ষার্থীদের বড় বাধা ইংরেজি। বিসিএস, ব্যাংকসহ প্রায় সব চাকরির পরীক্ষায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে শক্তভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে ইংরেজি বিষয়ের।

বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ৩৫ নম্বর এবং লিখিত পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের ইংরেজি রয়েছে। অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায়ও প্রায় ২৫ শতাংশ নম্বর থাকে ইংরেজিতে।  সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এক্ষেত্রেও বেশিরভাগ চাকরিপ্রার্থী ফেল করেন ইংরেজিতে। প্রাইভেট সেক্টরেও দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোতে চাকরি পেতে ইংরেজিতে দক্ষতা একটা বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। 

শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য বিদেশ যেতে চান, তাদেরকে আবার ইংরেজিতে দক্ষতা পরিমাপের আন্তর্জাতিক পরীক্ষা আইইএলটিএস, টোফেল, জিআরই, জিম্যাট প্রভৃতিতে প্রয়োজনীয় স্কোর তুলতে হয়, যা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পাশাপাশি স্কলারশিপ পেতেও সহায়ক হয়। 

অন্যদিকে, দেশের ইংরেজি শিক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক শ্রেণির অর্থনৈতিক খাত। স্কুল-কলেজ লেভেলের সিলেবাস পড়ানোর জন্য রয়েছে বিভিন্ন ‘একাডেমিক কোচিং সেন্টার’, এইচএসসি’র পর কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার জন্য রয়েছে ‘বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং’ এবং পড়াশোনা শেষে চাকরি পাওয়ার জন্য রয়েছে ‘জব প্রিপারেশন কোচিং’। এ ছাড়া রয়েছে স্পোকেন ইংলিশ এবং আইইএলটিএস কোচিং সেন্টারসমূহ। 

এসব কোচিং সেন্টারগুলোকে আপাত দৃষ্টিতে ছোট-খাট প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান মনে হলেও এগুলো বর্তমানে বিশাল এক ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। ইংরেজি শেখাতে এতো আয়োজন থাকা সত্ত্বেও পাল্টানো যাচ্ছে না শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে দুর্বলতার ভয়াবহ চিত্র। সবকিছু মিলিয়ে দেশের শিক্ষার্থীদের শুধু শিক্ষাজীবন নয়, পুরো জীবনটাই যেন আটকে আছে ইংরেজির মারপ্যাঁচে।

লেখক: ইংরেজি ভাষার প্রশিক্ষক ও সাংবাদিক

 

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি - dainik shiksha কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের - dainik shiksha কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক - dainik shiksha আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha অনির্দিষ্টকালের জন্য স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা শিক্ষা ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও প্রয়োজনীয় সংস্কার - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও প্রয়োজনীয় সংস্কার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040919780731201