ইউএনওর বিরুদ্ধে ইমাম মুয়াজ্জিন নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি |

ময়মনসিংহের নান্দাইলে সরকারের নির্মিত মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জনবল নিয়োগ নিয়ে চরম বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়েছেন নিয়োগ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল মনসুর। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউএনও আবুল মনসুর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত ভেঙে তার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের প্রার্থীদের প্রাধান্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই মডেল মসজিদে সদ্য নিয়োগ দেওয়া চারটি পদের মধ্যে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমসহ তিনটি পদেই নিয়োগ পেয়েছেন নিয়োগ কমিটির সভাপতির বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার প্রার্থীরা।

তবে ইউএনও আবুল মনসুরের দাবি, যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করেই নিয়োগ কমিটি উপযুক্ত প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়েছে। অবশ্য নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব জানিয়েছেন, তার সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ না করে সভাপতি তার পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়েছেন।

জানা গেছে, গত ৯ জানুয়ারি একাধিক দৈনিক পত্রিকায় নান্দাইল মডেল মসজিদে একজন পেশ ইমাম, একজন মুয়াজ্জিন ও দুজন খাদেম নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের বিপরীতে সব পদ মিলিয়ে শতাধিক আবেদন জমা পড়ে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সেসব আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে নিয়োগ কমিটি।

প্রবেশপত্রে লিখিত শর্তাবলি অনুযায়ী লিখিত পরীক্ষার পর ফলাফল নোটিস বোর্ডে ও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এমনকি মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) নেওয়ার পরও বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। আর তখন থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হতে থাকে ইমাম হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার জীনারি গ্রামের এক যুবক। যিনি সম্পর্কে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ইউএনওর ভাগিনা। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন জন বিভিন্ন পোস্ট দিতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে এই প্রতিবেদক তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে বিষয়টি নিয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে (ট্যাগ করে) একটি পোস্ট দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নিয়োগ কমিটির সভাপতি ইউএনও আবুল মনসুর নান্দাইল মডেল থানার ওসি মিজানুর রহমান আকন্দের মাধ্যমে এই প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন। অবশ্য পরে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে বলে ইউএনওর ঘনিষ্ঠ একজন এই প্রতিনিধিকে আশ্বস্ত করেন।

এরই মধ্যে ইমাম পদে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগের আশঙ্কা প্রকাশ করেন একই পদে আবেদনকারী মাওলানা হামিদুজ্জামান। তিনি নান্দাইল মডেল মসজিদের জায়গায় থাকা আগের মসজিদের সর্বশেষ খতিব ছিলেন। মাওলানা হামিদুজ্জামান ৩ মার্চ মুসল্লিদের উপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিয়োগ কমিটির সভাপতি নান্দাইল উপজেলা থেকে আবেদিত গুরুত্বপূর্ণ আলেম-ওলামাদের বাদ দিয়ে ওনার পছন্দমতো ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে তিনজনের প্যানেল করে তদন্তের জন্য পাঠিয়েছে। আমরা যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নান্দাইল উপজেলা থেকে সব জনবল নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আমরা নিয়োগ কমিটির বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করব।’

এ ছাড়া ১৭ মার্চ ইমাম পদে আবেদনকারী আমিনুল ইসলাম, হামিদুজ্জামান, বাহাউদ্দীন ও জুবায়ের তাদের স্বাক্ষরিত একটি লিখিত আবেদন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক বরাবর জমা দেন। ওই আবেদনে তারা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পেশ ইমাম নিয়োগের পাঁয়তারা চলছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। 

এত কিছুর পরও নিয়োগ কমিটির সভাপতির ১৬ মার্চ স্বাক্ষরিত নিয়োগপত্র ১৯ মার্চ জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, ইউএনওর ভাগিনা উল্লেখ করে যাকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা চলছিল, সেই রাকিবুল ইসলামই পেশ ইমাম পদে নিয়োগ পেয়েছেন। এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবারও সভাপতি নিয়োগে স্বজনপ্রীতি করেছেন দাবি করে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এনামুল হক ছোটন নামে একজন ফেসবুকের কমেন্ট বক্সে লেখেন, ‘নান্দাইলের ইউএনও একজন দুর্নীতিবাজ। তার মতো লোকের কারণে নান্দাইলের এমন অবস্থা।’ একই ব্যক্তি আরেকটি কমেন্টে লেখেন, ‘নান্দাইলের ইউএনওকে মানুষ বানিয়েই আল্লাহ ভুল করেছে।’ মাসুদুর রহমান নামে একজন কমেন্ট বক্সে লেখেন, ‘গত কিছুদিন পূর্বে আমি জাতীয় সংসদ ভবনে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে আবেদনপ্রত্যাশী হিসেবে দেখা করে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, এই পদে নান্দাইলের ইউএনওর পছন্দের লোক আছে।’ ইউএনওর সমালোচনা করে লেখা এমন অসংখ্য মন্তব্য এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে।

পেশ ইমাম পদে নিয়োগ পাওয়া রাকিবুল ইসলামের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার জীনারি গ্রামের রাহের আমিনের ছেলে। তবে ইউএনওর সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঢাকার উত্তরখানের জামিয়া ইসলামিয়া ফারুকিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন এই রাকিবুল ইসলাম। শিক্ষাগত সনদ অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৯৯ সালে। সে হিসাবে বয়স দাঁড়ায় ২৩ বছর। পেশ ইমাম পদে আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে নিয়োগ বিজ্ঞাপ্তির (ক) অনুচ্ছেদে খতিব, মুফতি বা মুহাদ্দিস হিসেবে কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছরের বাস্তবত অভিজ্ঞতা থাকার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু নিয়োগ পাওয়া ইমাম ২০২১ সালে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেছেন; যা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে ২০২১ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন রাকিবুল ইসলাম। পেশাদার খতিব বা মুহাদ্দিস হিসেবে তার চাকরি করার কোনো সুযোগ হয়নি।

এই নিয়োগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার মাওলানা মাজাহার নামে এক আবেদনকারী বলেন, ‘যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে আমি অনেক এগিয়ে ছিলাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। এরপরও রহস্যময় কারণে আমার চাকরি হয়নি। আমার এতে দুঃখ নেই, তবে একটি উপজেলার প্রথম শ্রেণির একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনভিজ্ঞ অল্প বয়সের যুবক ছেলে নিয়োগ দেওয়ায় সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য বিফলে যাবে।’

আমিনুল ইসলাম নামে আরেক আবেদনকারী বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই এমন একটি নিয়োগের বিষয়ে সন্দিহান ছিলাম। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। অনভিজ্ঞ ইমাম নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তির শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। যদি সে (রাকিবুল ইসলাম) অভিজ্ঞতার কোনো সনদ দিয়ে থাকে, সেটা অবশ্যই জালিয়াতির মাধ্যমে দিয়েছে। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি যে শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় তদন্ত সাপেক্ষে নিয়োগ বিজ্ঞাপ্তির ৮ নম্বর শর্ত মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন আবেদনকারী বলেন, ‘প্রবেশপত্রে উল্লেখ ছিল লিখিত ও ভাইভার ফলাফল নোটিস বোর্ড ও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু রহস্যময় কারণে আদৌ তা করা হয়নি। আমরা জানতে পারলাম না কত নম্বর পেয়েছি, কার অবস্থান কত। কেন প্রকৃত যোগ্য অভিজ্ঞ আলেমগণ নিয়োগবঞ্চিত হলো? কেউ যদি কোনো মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ায় তাহলে সে মোকাররার ইমাম হতে পারে, কিন্তু খতিব হতে পারে না। নিয়োগপ্রাপ্ত ইমাম লেখাপড়া শেষ করেছে ২০২১-২২ সালে, সে কখন খতিব হলো বা মুহাদ্দিস হলো? আমরা মনে করি স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে, তাই তদন্তসাপেক্ষে এই নিয়োগ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। নিয়োগ কমিটির সভাপতির গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায় হওয়ায় চারটি পদের মধ্যে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমসহ তিনটি পদেই নিয়োগ পেয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলার প্রার্থীরা।’

সার্বিক বিষয়ে আলোচিত এই নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন নান্দাইল উপজেলা শাখার কর্তাকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিয়োগ কমিটিতে থাকলেও এ ব্যাপারে সভাপতি (ইউএনও) আমার সাথে বিন্দুমাত্র পরামর্শ করেননি। উনি ওনার মনমতো নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া পেশ ইমাম পদে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার অভিজ্ঞতার সনদ দাখিল করলেও পড়াশোনার সনদের সাথে তা সাংঘর্ষিক।’

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে নিয়োগ পাওয়া পেশ ইমাম রাকিবুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় শুনে দশ মিনিট পরে কথা বলবেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিন্তু পরে আবার একাধিকবার কল করা হলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।

আর নিয়োগ কমিটির সভাপতি ইউএনও আবুল মনসুর বলেন, ‘যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করেই নিয়োগ কমিটি নিয়োগ দিয়েছে। সে (রাকিবুল ইসলাম) কখন কী পাস করেছে, এটা দেখার বিষয় নয়, তার ইমাম হিসেবে ছয় বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে।’ অবশ্য খতিবের অভিজ্ঞতার বিষয়টি এড়িয়ে যান ইউএনও। তিনি বলেন, ‘এগুলো আপনাদের দেখার বিষয় না।’ আর ফলাফল নোটিস বোর্ডে টানানো বা প্রকাশ না করার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘ফলাফল প্রকাশ করার কোনো বিধান নেই।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002514123916626