ইউএনও ওয়াহিদার বাসায় ৪০ লাখ টাকা, নানা প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক |

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসার আলমারিতে থাকা ৩৫ লাখ টাকা, পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার, স্বর্ণালঙ্কার, ব্যাংকের চেক, জমির রসিদ ও দলিলপত্র পাওয়া গেছে। গত রোববার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহানুর রহমানের উপস্থিতিতে পুলিশের একটি টিম তার বাসার আলমারিতে এসব টাকা ও অন্যান্য জিনিসপত্র অক্ষত দেখতে পায়। পরে তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মামলার বাদী ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ভাই শেখ ফরিদ উদ্দিনের কাছে তুলে দেওয়া হয়। সরকারি বাসভবনের আলমারিতে এত অর্থের উৎস নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। দৈনিক সমকালের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা যায়। 

প্রতিবেদনের বিস্তারিত : 

“গত রোববার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহানুর রহমানের উপস্থিতিতে ঘোড়াঘাট থানার ওসি আজিম উদ্দিন, পরিদর্শক (তদন্ত) মমিনুল ইসলাম ও মামলার বাদী ওয়াহিদা খানমের ভাই শেখ ফরিদ উদ্দিন ইউএনওর বাসায় আলামত দেখার সময় উপস্থিত ছিলেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যদি সত্যি সত্যি ইউএনওর বাসায় এত বিশাল অঙ্কের টাকা পাওয়া যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। মাঠ পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তার বাসায় এত টাকা থাকার কথা নয়। তার আলমারিতে এই টাকা পাওয়া গেলে তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।

ঘোড়াঘাট থানার ওসি আজিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, মামলার আলামত হিসেবে একটি চাবির গোছা পেয়েছি। সেটা নিয়ে রোববার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ইউএনওর বাসায় যাই। দলিলপত্রসহ অন্য যা কিছু তার বাসায় পাওয়া গেছে, তা পরিবারের সদস্যদের কাছে দেওয়া হয়েছে। তবে টাকার ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি ওসি।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহানুর আলম ও মামলার বাদীর বক্তব্য জানতে মোবাইলে একাধিক দফায় ফোন করলেও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে ওই হামলার পর ঘোড়াঘাটে ইউএনওর বাবার নামে জমি কেনা ও অবৈধ বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।

এর আগে ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায় সাসপেন্ড কর্মচারী রবিউল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে দিনাজপুরের ডিবি পুলিশ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। রবিউল ইউএনওর বাসায় মালি হিসেবে কাজ করতেন। ইউএনও এবং তার বাবার ওপর হামলার পর ওই বাসা থেকে ৫০ হাজার টাকা চুরি করেছিলেন রবিউল। ওই টাকা ইউএনওর ব্যাগে ছিল। তবে আলমারি খুলতে না পারায় বাসায় লাখ লাখ টাকা থাকলেও তা সরাতে ব্যর্থ হন তিনি। তবে রবিউল পুলিশকে জানান, টাকা চুরি করা তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। চুরির অপরাধে সাসপেন্ড হন তিনি। আবার ১৬ হাজার টাকা চুরি করে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপরও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মূলত এই ক্ষোভ থেকেই ইউএনওর ওপর হামলার টার্গেট করেন তিনি।

চলতি বছরের শুরুর দিকে রবিউলকে সাসপেন্ড করা হয়। ইউএনওর ব্যাগ থেকে ১৬ হাজার টাকা চুরির দায়ে তার বিরুদ্ধে ওই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবে ওই ঘটনার পর ইউএনওকে রবিউল ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। রবিউলকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। ইউএনও ওই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় তাকে টার্গেট করেন রবিউল।

রবিউল জানান, চুরির দায়ে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার পর রবিউলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে কথা দিলেও চুরির বিষয়টি উল্লেখ করে রবিউলের ব্যাপারে প্রতিবেদনও দেন ইউএনও। মূলত এই ক্ষোভ থেকে তার ওপর হামলা করতে হাতুড়িও কিনে রেখেছিলেন তিনি।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, রবিউলের গোপন একটি মোবাইল ফোন নম্বর ছিল। ঘটনার দিন ঘোড়াঘাটে যাওয়ার পর চার্জ না থাকায় তার মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। আর গোপন নম্বরটি একমাত্র রবিউলের স্ত্রী জানতেন। স্বামীর মোবাইল নম্বর বন্ধ দেখে বারবার ওই নম্বরে ফোন দিতে থাকেন তিনি। তবে রবিউল ইউএনওর ওপর তার হামলার পরিকল্পনার কথা কাউকে জানাননি। তাই স্বামীর মোবাইল ফোন বন্ধ ও বাড়ি ফেরায় বিলম্ব হওয়ায় দুঃশ্চিন্তায় পড়েন রবিউলের স্ত্রী। তদন্তকালে রবিউলের স্ত্রী একটি নম্বরে বারবার কল করছিলেন- এ বিষয়টি ক্লু শনাক্তে সংশ্নিষ্টদের কাজে লাগে।

আরেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর অনেক আলামত পুড়িয়ে দিলেও নিজের পরনের প্যান্ট পোড়াননি রবিউল। ইউএনওর ওপর হামলার পর তার রক্তের চিহ্ন রবিউলের প্যান্টে থাকতে পারে। আবার ইউএনওর বাবার সঙ্গে তার ধস্তাধস্তি হয়েছিল। এটার আলামতও তার প্যান্টে রয়েছে। প্যান্টের আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনায় ব্যবহূত মই, বাসার বাথরুমের দরজা থেকে ফিঙ্গার প্রিন্টের ছাপ নিয়ে তা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। তদন্ত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ডিএনএ এবং ফিঙ্গার প্রিন্টের এসব পরীক্ষায় রবিউলের বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত হবে। বিচারের সময় দোষীর শাস্তি নিশ্চিতে এসব প্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, আসামি শনাক্তে ঘটনাস্থলের ছয়টি সিসিটিভির ফুটেজ তারা পরীক্ষা করেছেন। প্রথমদিকে মনে হয়েছিল দুই ব্যক্তি বাসায় ঢুকেছিল। পরে আরও সূক্ষ্ণভাবে যাচাই করে দেখা যায়, ঘটনার দিন ইউএনওর বাসার ভেতরের আলো-আঁধারি পরিবেশের কারণে এই বিভ্রান্তি দেখা দেয়। একই পোশাকে একজন ব্যক্তি হামলাকারী হলেও আলোতে এক রং আর অন্ধকারে আরেক রঙের পোশাক পরিহিত বলে মনে হয়েছিল। পরে এই বিভ্রান্তি দূর হয় তদন্ত সংশ্নিষ্টদের।

এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ছয় দিনের রিমান্ড শেষে আজ বৃহস্পতিবার রবিউলকে আদালতে তোলা হবে। রিমান্ডে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এরই মধ্যে সবকিছু স্বীকার করেন তিনি। আজ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিতে পারেন তিনি। একাই ইউএনও ও তার বাবার ওপর হামলা চালিয়েছেন বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান রবিউল। দেয়াল টপকে ঘটনার দিন রাত দেড়টার দিকে ইউএনওর সরকারি বাসার কম্পাউন্ডে ঢোকেন তিনি। ভেন্টিলেটর দিয়ে সাড়ে ৩টার দিকে ঢোকেন মূল বাসায়। বাথরুমে ৩০ মিনিটের মতো আটকা ছিলেন রবিউল। ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ধাক্কা দেওয়ার পর খুলে যায় বাথরুমের দরজা। তখন শব্দ পেয়ে ঘুম ভাঙে ওয়াহিদার। ঘুম ভাঙার পরপরই বিছানার ওপর ওয়াহিদাকে আঘাত করেন রবিউল। এরপর তার বাবা এগিয়ে এলে তাকেও আঘাত করেন তিনি। পরে ইউএনওর ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর থেকে ৫০ হাজার টাকার একটি বান্ডেল নেন রবিউল। আলমারি খোলার জন্য চাবিও নিয়েছিলেন। তবে ওই সময় ইউএনর ছোট্ট সন্তানের ঘুম ভেঙে যায়। সে কান্নাকাটি শুরু করে। আবার ভোরও হয়ে যাচ্ছিল। তাই দীর্ঘ সময় আলমারির তালা খোলার চেষ্টা না করেই বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন রবিউল।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল জানান, বিরামপুরের বাসা থেকে ঘোড়াঘাট পৌঁছে মডার্ন মসজিদের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেন তিনি। প্রথমে এক ঘণ্টা রেকিও করেন রবিউল। রাত ১টা ১৯ মিনিটে রবিউল গার্ড রুমের সামনে নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর ইউএনওর বাসভবনের পশ্চিম দিকের দেয়াল টপকে বাসভবন চত্বরে ঢোকেন। এরপর মই ও চেয়ার দিয়ে সরকারি বাসার দোতলায় উঠতে প্রথমে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে অপারেশন সম্পন্ন না করেই চলে যাওয়ার কথা ভাবতে থাকেন। পরে দ্বিতীয় দফায় মূল ভবনে ঢুকতে সক্ষম হন। অপারেশন শেষ করে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে বিরামপুরে গিয়ে নামেন। বিরামপুর শহরের একটি জায়গায় লাল শার্ট, গামছা, মাংকি ক্যাপ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এরপর বাসায় ফিরে গোসল করে ভাত খান। পরে আবার সাইকেল নিয়ে দিনাজপুরে ডিসি কার্যালয়ে যান।”


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002532958984375