বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতিতে অনিবার্য এক নাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বাংলার আপামর জনতা যাকে ‘বাংলার বুলবুল’ বলে সম্ভোধন করতো। রাজপথের মিছিলে, কখনো বা লাখো জনতার সমাবেশে স্লোগান ওঠতোÑ‘বাংলার বুলবুলÑসৈয়দ নজরুল’। রাজনীতিতে তার নেতৃত্ব, যোগ্যতা নিয়ে কখনো কোনো প্রশ্ন ছিলো না। ইতিহাসের পাঠ থেকেই জানা যায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন তিনি। বয়সে ছোট হওয়া সত্বেও বঙ্গবন্ধু তাকে স্যার বলে ডাকতেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামও সভা-সমাবেশে শেখ মুজিবকে ‘প্রিয়তম বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। তার এই প্রিয়তম বন্ধুটি যখনই রাজনৈতিক কারণে রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত থাকতেন তখনই দায়িত্ব পড়ত তাঁর উপর। রাজনীতির কঠিন সেই মুহূর্তগুলো তিনি অত্যন্ত সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। যতোবার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ততোবারই তাকে নিতে হয়েছে দলের দায়িত্ব।
তিনি সে দায়িত্ব সামাল দিয়েছেন বীরের মতো। তার জন্ম যে বীরদাম পাড়ায়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যতোবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন ততোবারই তার পদে ভারপ্রাপ্ত হয়েছেন সৈয়দ নজরুল। পক্ষান্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলামও তার নেতার প্রতি ছিলেন প্রবল বিশ্বস্ত ও অনুগত। যা শেষ পর্যন্ত তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন। আজ সেই শুদ্ধ রাজনীতিকের ৯৯তম জন্মদিন। রাত পেরুলেই তার জন্মের শতবর্ষ গণনা শুরু। না তেমন কোনো আয়োজন নেই, উদযাপন নেই তাকে স্মরণে। অথচ ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে বড়ো আশ্চর্য হতে হয়! এমনই এক নির্মোহ রাজনীতিক ছিলেন তিনি।
পৃথিবীব্যাপী তখন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে লড়াই চলছে, ক্ষমতার পালাবদল, ফ্যাসিবাদের উত্থান, একদিকে পুঁজির বিকাশ অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দা। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমশ তৈরি হচ্ছে দূরত্ব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা আর ভয়াবহতার ছাপ বিশ্ববাসীর চোখে-মুখে লেগে আছে স্পস্ট। ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে এসে শাসক বণে যাওয়া অত্যাচারী ব্রিটিশদের তাড়ানোর লড়াই তখন তুঙ্গে। এমনই এক উত্তাল সময়ে ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিংহ জেলার তদানীন্তন কিশোরগঞ্জ মহকুমার যশোদল ইউনিয়নের বীর দামপাড়া গ্রামের সাহেব বাড়িতে জন্ম হয়েছিলো সৈয়দ নজরুল ইসলামের।
তার লেখাপড়া শুরু হয় নিজ গ্রামের যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুলে। এরপর কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণ করেন। তারপর পিতার চাকুরি সূত্রে চলে যান জেলা শহর ময়মনসিংহে। ভর্তি হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে দুই বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর ভর্তি হন আনন্দমোহন কলেজে। সেখান থেকে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। উচ্চ শিক্ষা নিতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের এমএ পাস করেন। তখন তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি (১৯৪৬-৪৭)। তার ও কয়েক বছর পরে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো তিনিও কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের শুরুতেই নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন মানব মুক্তির লড়াইয়ে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের অন্যতম বীরসেনানী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। শুরুটা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে যখন পূর্ববাংলার ওপর অযাচিতভাবে চাপিয়ে দিতে চাইল, তখনই ঘুরে দাঁড়ায় বাংলার ছাত্রসমাজ। অন্য অনেকের মতো সেদিনের তরুণ ছাত্রনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামও যোগ দেন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে। মহান ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা অনন্য। সেদিনের সেই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের হয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ২ মার্চ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আয়োজিত এক সভায় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণ আজাদী লীগসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিতেও ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
সার্বক্ষণিক ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হয়েও খেলাধুলার সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি নিজেকে সমানতালে যুক্ত রেখেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি খেলেছেন ক্রিকেট এবং হকি। এসব খেলায় পারদর্শী হওয়ায় তাকে দলের অধিনায়ক করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হকি ও ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন থাকা অবস্থায় দলকে সংগঠিত করেছেন, দলের জন্য ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। খেলাধুলার প্রতি তার অনুরাগের ফলে পরবর্তী সময়ে তাকে ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনেও ভূমিকা রাখেন। দলটি গঠন করার জন্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুন গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। তিনি ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
ভাষা আন্দোলন থেকে সেই যে শুরু হলো এরপর ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থাণ, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপ ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন ইত্যাদি সবই তিনি করেছেন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় তাকে সংকাট-মানব হিসেবে অভিহিত করে। পত্রিকাটি চতুর্থ সংখ্যায় ‘সংকট-মানব সৈয়দ নজরুল’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয় ‘স্বাধীন-বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কর্ণধার সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাঙ্গালীদের কাছে একজন সংকট-মানব হিসেবে পরিচিত। বস্তুতঃ আওয়ামী লীগ ও বাঙ্গালী যখনই কোন সঙ্কটে পতিত হয়েছে তখনই তার ওপর অর্পিত হয়েছে পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব। সহজ সরল নীতিনিষ্ঠ এই মানুষটি কথার চেয়ে কাজ করেন বেশি, চিন্তা করেন আরো বেশি।’
বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। জীবনবাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিজের দিকে, পরিবারের দিকে তাকাননি। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। নিজ কর্মগুণে সারা পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তিনি অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তার অপরাপর সহযোদ্ধাদের নিকটও। তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ অন্যদের কাছেও গ্রহণযোগ্য ও সম্মানীয় ছিলেন। দলের অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া বিরোধ তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিষ্পত্তি করেছেন। বলা হয়, যদি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা না করতেন, পাশে না থাকতেন, তাহলে ইতিহাস হয়ত অন্য পথেই হাঁটত। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ‘আমার একাত্তর’ বইতে লিখেছেন, তাজউদ্দীন আমাকে খোলাখুলিই বলেছিলেন যে, তার প্রধানমন্ত্রিত্বের ব্যাপারে দলের মধ্যে বড়োরকম বিরোধিতা আছে।...তবে তার বিরুদ্ধে দলের মধ্যে অন্য গ্রুপও যে সক্রিয়, তা তিনি জানিয়েছিলেন, কিন্তু সে গ্রুপে কারা ছিলেন, তা বলেননি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যে তাজউদ্দীনকে বড়োরকম সমর্থন দিচ্ছেন, এ কথা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে উল্লেখ করেছিলেন একাধিকবার।’
নিজ জীবনকে বিপন্ন্ন করে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভূমিকা অনন্য, অসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে সরকার পুনর্গঠন করে বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপরাষ্ট্রপতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে কাজ করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে, লক্ষ লক্ষ বেকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তিনি নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করেছেন। ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। এসবের মধ্যে নিজ দল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রেখেছিলেন নিজেকে। পালন করেছেন বাকশালের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। হয়েছিলেন বাকশালের পলিট ব্যুরোর সদস্য। কেন্দ্রীয় কমিটিতে বঙ্গবন্ধুর পরেই ছিলো তার অবস্থান। ব্যক্তিজীবনেও তিনি অত্যন্ত সৎ জীবনযাপন করেছেন। সেই সহজ মানুষটিকেই ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের অনিবার্য এ মানুষটিকে তার জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
লেখক: গবেষক ও সম্পাদক
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।