ইতিহাস বদলে দেয়া আলতামিরা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

হাজার হাজার বছর আগে, যখন মানুষ ছিলো গুহাবাসী, বা থাকতো খোলা আকাশের নীচে, কেমন ছিল তাঁদের জীবনযাপন? প্রায়ই এই নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। আমাদের মনে এই প্রশ্নও ওঠে যে, সে সময় মানুষের বুদ্ধি, মেধা, শিল্পচর্চায় আগ্রহ কতোটা ছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত স্পেনের আলতামিরা গুহা।

স্পেনের ক্যান্টাব্রিয়ায় সান্টিলানা ডেল মারের কাছে রয়েছে এই আলতামিরা গুহা। প্যালিওলিথিক যুগে মানুষের জীবন কেমন ছিলো, তার ছবি ধরা পড়েছে এই গুহাগুলোতে। এই প্যালিওলিথিক যুগকে প্রস্তর যুগও বলা হয়।

এই আলতামিরা গুহা থেকে মিলেছে পাথরের যন্ত্র, বাসনপত্র থেকে হাড়ের উপর খোদাই করা বিভিন্ন জিনিস। তবে এই গুহার গায়ে আঁকা ছবি ইতিহাসবিদদের ধারণা বদলে দিয়েছে। কয়েক লক্ষ বছর আগে শুরু হওয়া প্রস্তরযুগেও মানুষের শিল্পজ্ঞান যে কতটা আধুনিক ছিল, তারই প্রমাণ মিলেছে।

এই গুহায় রয়েছে ষাঁড়, হাত, অ্যাবস্ট্রাকট কিছু প্রতীকের ছবি। এ সব দেখে বিস্মিত ইতিহাসবিদেরা। ওই সময়েও মানুষের ভাবনাচিন্তা কতটা আধুনিক ছিলো, দেখে বিস্মিত হন তাঁরা। ইউনেস্কো এই গুহাকে আগেই ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করেছে।

উনবিংশ শতাব্দীতে এই আলতামিরা গুহা আবিষ্কার করা হয়েছিল। তার আগে পর্যন্ত এই গুহার দরজা বন্ধ ছিলো। পাথর পড়ে আটকে গিয়েছিল গুহার মুখ। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় শিকারি মডেস্ট কিউবিলাস গুহাটি খুঁজে পেয়েছিলেন।

গুহার মালিক মার্সেলিনো সনজ় দে সতোলার কাছে গিয়ে মডেস্ট এই গুহার খবর দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, গুহার মধ্যে কী দেখেছেন তিনি। যদিও সে সব শোনার পরেও মার্সেলিনো গুহায় যাননি। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম বার ওই গুহায় যান। গিয়ে খুব একটা খুশি হননি গুহার মালিক মার্সেলিনো। তাঁর মনে হয়েছিল, সে সবই আসলে অর্থহীন কিছু প্রতীক।

১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে একটি প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলেন মার্সেলিনো। প্রদর্শনী দেখে একটু চমকেই গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে যা দেখেছিলেন, তার সঙ্গে মিল ছিলো গুহার জিনিসপত্রের। তিনি ওই প্রদর্শনীতে হাড়ের উপর খোদাই করা বেশ কিছু জিনিস দেখেন। সে রকম জিনিসপত্রই তিনি দেখেছিলেন আলতামিরা গুহায়।

এর পরেই দেশে ফিরে প্রত্নতত্ত্ববিদ জুয়ান ভিলানোভা ওয়াই পিয়েরার সঙ্গে জোট বেঁধে খননকার্য শুরু করান মার্সেনিলো। পিয়েরা মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ওই গুহায় খননকার্য শুরু হয়। তা শুরু হতেই একের পর এক পশুর হাড়, বাসনপত্র উদ্ধার হয়।

এক দিন গুহায় আট বছরের ছোট মেয়ে মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মার্সেলিনো। মারিয়াই প্রথম একটি গুহাকক্ষের দেওয়ালে ষাঁড়ের ছবিটি দেখে। সেই ষাঁড়ের ছবি বিখ্যাত করেছে আলতামিরা গুহাকে।

গুহায় খননকার্য চালিয়ে যা মিলেছিল, তা লিখে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে। তবে ইতিহাসবিদরা সেই রিপোর্ট খারিজ করে দিয়েছিলেন। তাঁরা মানতে চাননি যে, ছবিগুলি প্রাচীন প্রস্তর যুগে আঁকা হয়েছিল। ছবিগুলি এতোটাই আধুনিক যে, ইতিহাসবিদেরা তা প্রতারণা বলে দাগিয়েছিলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, গুহায় আধুনিক কোনও শিল্পী সে সব এঁকে গিয়েছেন।

বিংশ শতাব্দীতে ওই এলাকায় আরও কিছু গুহায় আলতামিরার মতোই ছবি আবিষ্কার করেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। তার পরেই তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আলতামিরা গুহায় যে সব ছবি মিলেছে, সেগুলি প্রস্তরযুগেই আঁকা হয়েছিল। প্রতারণা নয়।

তার পর থেকে নতুন করে শুরু হয় গবেষণা। ইতিহাসবিদেরা এখনও গবেষণা করে চলেছেন, ঠিক কোন সময়ে আঁকা হয়েছিল এই গুহাচিত্র। ইতিহাসবিদের মনে করেন, আলতামিরার গুহাচিত্রে দু’টি সংস্কৃতি, সভ্যতার মিল ঘটেছে। সেই দুই সংস্কৃতি একই সময়ের নয়।

ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, সোলুট্রিয়ান (২১ হাজার থেকে ১৭ হাজার বছর আগে ছিলো সেই সভ্যতা) এবং ম্যাগদালেনিয়ান সভ্যতার (১১ হাজার থেকে ১৭ হাজার বয়সি) নির্দশন এই গুহাচিত্র।

প্রস্তর যুগের একেবারে শেষ ভাগে পৃথিবীতে ছিল এই সোলুট্রিয়ান এবং ম্যাগদালেনিয়ান সভ্যতা। এঁরা যন্ত্র তৈরি এবং শিল্পকর্মে নিপুণ ছিলেন। আলতামিরার বেশির ভাগ গুহাচিত্র এদেরই তৈরি।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে এই গুহাচিত্রের ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম ডেটিং করে বয়স জানার চেষ্টা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, প্রায় ২০ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে আঁকা হয়েছে এই গুহাচিত্র। এর ভেতরে যা মিলেছে, সেগুলোও ওই দু’টি সভ্যতার নিদর্শন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এক-একটি গুহাচিত্রের বয়সের ফারাক ১০ হাজার বছর।

আলতামিরার গুহা ৮৭১ ফুট দীর্ঘ। যদিও গুহার সামনেই দিকে বসবাস করতেন লোকজন। তবে প্রায় পুরো গুহা জুড়েই তাঁরা এঁকে রেখেছিলেন অসংখ্য ছবি।
আলতামিরা গুহার ছাদেও আঁকা রয়েছে ছবি। এমনিতে গুহার প্রাচীরে ৩.৮ ফুট থেকে ৮.৭ ফুট উচ্চতায় আঁকা রয়েছে সব ছবি। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, প্রথমে খোদাই করে ছবি আঁকা হয়েছিল গুহার গায়ে। তার পর তাতে রং দেওয়া হয়েছে।

লাল, কালো আর বেগুনি রং ব্যবহার হয়েছে এই ছবিতে। চারকোল দিয়ে ছবিগুলির সীমানা আঁকা হয়েছে। ভিতরে হেমাটাইট (লৌহ আকরিক) দিয়ে ছবিতে লাল রং ভরা হয়েছে। সেই রং এখনও একই রকম রয়ে গেছে।

ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, সব থেকে আধুনিক, সুন্দর ছবিগুলি আঁকা হয়েছে ম্যাগদালেনিয়ান সভ্যতার শেষ দিকে। গুহায় ২৫টি বাইসন, হরিণ, ঘোড়ার ছবি রয়েছে। ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, ধর্মীয় রীতির অংশ হিসাবে এই ছবিগুলি আঁকতেন আদি মানবেরা।

সূত্র: আনন্দবাজার 

 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে - dainik shiksha চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ - dainik shiksha সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন - dainik shiksha রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? - dainik shiksha বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে - dainik shiksha ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি - dainik shiksha প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027401447296143