ইনক্রিমেন্ট অনুকম্পা নয়, অধিকার

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

এক এক করে তিনটা জুলাই গত হয়েছে। পার হয়েছে তিনটা বৈশাখ। আজ তিনটে বছর থেকে জাতীয় বেতনস্কেল সুবিধাভোগীদের জুলাই নিয়ে আসে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির বার্তা আর বৈশাখ এনে দেয় নববর্ষ ভাতার সওগাত। কর্মস্পৃহা ও কর্মোদ্যম বাড়াতে এ দু'টো প্রণোদনা সবার প্রাপ্য। সকলের ন্যায্য অধিকার। এগুলো কারো অনুগ্রহ কিংবা অনুকম্পা নয়। কর্মের সম্মান। কাজের স্বীকৃতি। দেশ ও জাতির জন্যে যারা দিনান্ত পরিশ্রম করেন তারা সকলে এ দুটো প্রণোদনা পেয়ে থাকেন। কিন্তু স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে দেশের পাঁচ লক্ষ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী, যারা যথাবিধি অষ্টম জাতীয় বেতনস্কেলে শত ভাগ নিজ স্কেলে বেতন পান, আজ পর্যন্ত বৈশাখী ভাতা কিংবা প্রবৃদ্ধি কোনটিরই মুখ দেখেননি। সিকি আনা বোনাস নিয়ে এই সেদিনও একটা বড় ঈদ অনেক কষ্টে পার করেছেন তারা। তাদের সাথে এ কেমন অন্যায়-অবিচার? এ কী রকম বৈষম্য? পাকিস্তান আমলের জঘন্য সব বৈষম্যকেও হার মানিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যহীন সোনার বাংলার স্বপ্নের গালে এ যেন এক নির্মম চপেটাঘাত। যে বৈষম্যের জন্যে একাত্তরে একটি মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সে সবের চেয়ে এগুলো কম কীসে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে শিক্ষকদের অন্য কারো হাতের দিকে চেয়ে থাকতে হতো না। একজন বঙ্গবন্ধু মুজিবের শিক্ষা ও শিক্ষকপ্রীতির কারণে তার দলের প্রতি শিক্ষক সমাজের এখনো পর্যন্ত অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস।

আজ থেকে তিরিশ বছর আগে শিক্ষকতায় যেদিন প্রথম প্রবেশ করি, সেদিনও সিনিয়রদের মুখে শুনেছিলাম আওয়ামী লীগ কোনদিন ক্ষমতায় গেলে সব স্কুল-কলেজ সরকারি করে দেবে। কেন জানি সে সময় আওয়ামী লীগ ঘরানার নয় এমন অনেক শিক্ষকের মুখেও এমন কথা বহুবার শুনেছি। লক্ষ্য করেছি তারা সবাই এক কঠিন দৃঢ় মনোবল নিয়েই কথাটি বলেছেন। সে সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বলয় থেকে যোজন যোজন দূরে আর শেখ হাসিনা জীবনের সবচে' কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ। তদুপরি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি সেদিনের শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকগণ এক অন্য রকম আস্থা ও বিশ্বাস লালন করতেন। সে আস্থা ও বিশ্বাস সেদিনের শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে কঠিন দুঃসময় পেরিয়ে আজকের সুসময়টিতে উত্তীর্ণ হতে কিছুটা হলেও সহায়তা করেছিল। বাংলাদেশ খুঁজে পেয়েছিল তার নিজের অস্তিত্ব। একান্ত আপন ঠিকানাটি। সে থেকেই বাংলাদেশ এগিয়ে। গৌরবে তার পথ চলা শুরু । শিক্ষায় ও বাংলাদেশ ততদিনে কম এগিয়ে যায়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত নানা কর্মসূচির সাফল্য সারা দুনিয়ার মানুষের নজর কেড়েছে বটে। কেবল এদেশের শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকগণ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে আজ অন্ধকার তিমিরে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। কষ্টের দীর্ঘশ্বাসে তাদের শুধু বুক নয় কলিজাটা ও ফেটে চুরমার হয়ে যায়। টাকা পয়সা বড় কথা নয়। মান সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি আজ বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশাখী ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট তারা পাবেন না কেন? না পাবার হেতুটা খুঁজে পাই না। কেবলই ঘুরে ফিরে সরকারের ব্যর্থতা সামনে চলে আসে। কেবল সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তা হচ্ছে না। ভাবনায় তো এর বাইরে আর কিছু আসে না। খুঁজে খুজেঁ আর কিছু পাওয়াও যায় না। শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব সরকারকে এ কাজটি কে করতে দেয় না? কারা সরকারকে সাবোটাজ করতে চায়? শিক্ষকদের রোষানলে ফেলে দিতে চায়? বঙ্গবন্ধুর পরে তিন মেয়াদ ও টানা দুই মেয়াদের প্রান্ত সীমানায় শেখ হাসিনা ও তার দল। কেবল বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশে নয় পুরো এশিয়া জুড়ে দলটির আলাদা এক গৌরবময় ঐতিহ্য। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে হিসেব থেকে বাদ দিয়ে আজ আর কারো চলা সম্ভব নয়। অমিত সম্ভাবনার এই বাংলাদেশের শিক্ষকরা যদি অন্যান্য দেশের শিক্ষকদের মতো মর্যাদা ও আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে না পারেন তাহলে আমাদের সব দম্ভ এমনিতেই চুরমার হয়ে যায়। সারা দুনিয়ার সামনে আমাদের মুখ দেখানো ভার হয়ে ওঠে। প্রতিটি বেসরকারি স্কুল-কলেজ তার প্রয়োজনের অর্ধেক জনবল নিয়ে চলে। আবার অনেক বিষয়ের কোনো শিক্ষক নেই। যারা আছেন তারাই সে সব বিষয় ও পড়িয়ে থাকেন। তাই তাদের ডাবল কাজ। মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, শিক্ষাবোর্ড, জেলা প্রশাসন এবং উপজেলা প্রশাসন বাদে ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডি তো আছেই। সবার মন জুগিয়ে চলা লাগে। বেসরকারি শিক্ষকদের কত জ্বালা! কিন্তু তাদের সুযোগ সুবিধার বিষয়টি দেখার কেউ নেই। 

গাঁও-গেরামের প্রবাদ, 'কার গোয়াল, কে দেয় ধোঁয়া'? বেসরকারি শিক্ষকগণ এ প্রবাদটির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে চরম মনঃকষ্টে দিনাতিপাত করে যাচ্ছেন। এ রকম হবার তো কোনো কথাই ছিল না। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অনেক কথা বলেন কিন্তু কিছুই দিতে পারেন না। তার সীমাবদ্ধতা আজো খুঁজে পাইনে। সারাটা জীবন এ মানুষটি শিক্ষার জন্যে লড়াই সংগ্রাম করেছেন। ক্ষমতা পেয়ে কী অন্য রকম হয়ে গেলেন? বৈশাখী ভাতা আর ইনক্রিমেন্ট শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনা। একান্ত অধিকার। এ সব আপনাআপনি পাবার কথা। এর জন্যে আদালতে রিট করা লাগে না। রাজপথে মিছিল মিটিংয়ের প্রয়োজন পড়ে না। এগুলো এমনি দিয়ে দিতে হয়। দেন দরবারের এখানে কী আছে? কিন্তু এতদিন পর এখন কেন জানি মনে হয় 'সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না। ঘি ওঠাতে আঙুল বাঁকা করা লাগে'। আজ একদল, কাল আরেক দল, পরশু অন্যদল। এরকম কর্মসূচি দিয়ে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত কোনদিন অধিকার আদায় হবে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়েছিলাম, 'অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। অধিকার আদায় করে নিতে হয়'। অধিকার আদায়ে সকল শিক্ষক-কর্মচারীকে বিনা শর্তে এক কাতারে দাঁড়াবার এখনি উপযুক্ত সময়। 

                          
লেখক : অধ্যক্ষ , চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ , কানাইঘাট , সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002345085144043