দেশের চলমান পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ-এ ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি এবং ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বিষয়ভিত্তিক সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যোগ্যতাভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক শিখন যোগ্যতা অর্জন করে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ পরিবর্তন সময়োপযোগী। তবে এর সুফল গ্রহণ করতে হলে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে শক্ত হাতে। এর জন্য দরকার যোগ্য নেতা ও নেতৃত্ব। আর এ পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে দরকার সুদক্ষ শিক্ষক যারা জাতির নেতা, নেতৃত্ব দানে অকুতোভয় সৈনিক। যুগে যুগে যারা এ কাজটা করে আসছেন, ভবিষ্যতেও তারা এ স্বাক্ষর রাখবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু ভাবটা এ রকম না, ভাবনাটা আলাদা। উচ্চ দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে আমরা কি সত্যি সেনিক হতে পারব! বেতন দশ থেকে বার হাজার টাকা। ছয় জনের সংসার চলবে কী করে? দেশ স্বাধীন করেছিলাম পেটে গামছা বেধে। দেশ স্বাধীন হলো ঠিকই কিন্তু মহান পেশায় মানুষ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে স্বল্প বেতনের বেড়াজালে আটকে গেলো জীবন। জীবন চলছে জীবনের নিয়মে। অনেকটা আবেগ তাড়িত হযে মনের কথা, প্রাণের কথা, ভালোবাসার কথাটা বলে ফেললাম।
অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নে সকল স্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ইন-হাউস প্রশিক্ষণ আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠান প্রধান ও প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকদের সমন্বয়ে স্ব-উদ্যোগে ইন-হাউজ প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে হবে স্ব স্ব স্কুলে। আর শিক্ষক সহায়িকা অনুসারে ক্লাস পরিচালনা করছেন কি না তা মনিটরিং করতে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের।
অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরী স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, নতুন কারিকুলাম যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান প্রধান তার প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের সমন্বয়ে স্ব-উদ্যোগে ইন-হাউজ প্রশিক্ষণ আয়োজন করবেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান প্রধান তার প্রতিষ্ঠানের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের নেয়া প্রশিক্ষণ অনুযায়ী শিক্ষক সহায়িকা অনুসরণ করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন কি না তা মনিটরিং করবেন। ইন-হাউস প্রশিক্ষণ আসলে কী? ইন-হাউস প্রশিক্ষণ হলো, যেকোনো সংস্থা বা অধিদপ্তরের কর্তা বা কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা অভ্যন্তরীণ উন্নত শিক্ষা বাস্তবায়নের বা উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা।
অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ প্রশিক্ষানার্থী নিজেদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার সুযোগ দেয়। এটি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন মেটাতে ব্যক্তিগতভাবে তৈরি করা পদ্ধতি প্রদান করে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যদেরকে অনুপ্রাণিত যা নিজের শিখনকে সমৃদ্ধ করে।। টিম বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে সতীর্থদের প্রশিক্ষণের সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নিজেদের ছোট ছোট ভুলকে শুধরানোর সুযোগ সৃষ্টি করে।
অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের অর্থ হলো প্রশিক্ষণটি বাস্তব জীবনের উদাহরণ ব্যবহার করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান করার জন্যে উৎসায়িত ও অনুপ্রাণিত করে, সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টি করে৷ অংশগ্রহণকারীরা একটি সাধারণ উদাহরণের পরিবর্তে বর্তমান কাজ বা কাজের উদাহরণগুলোতে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে যা তাদের অবস্থানের সঙ্গে উপযোগী। ভালো, প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষাণার্থী আরো কার্যকরী এবং স্বল্প সময়ে আরো বেশি উপযোগ তৈরিতে সক্ষম হন। বিদ্যমান অবস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দলগত দক্ষতা সুদৃঢ় করে। এটি সুবিধাজনক হয়ে ওঠে যখন প্রশিক্ষণ নির্দিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে আয়োজিত হয়। এটা নিশ্চয়ই সবাই বিশ্বাস করবেন যে একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দলগত শৃঙ্খলার অভাব যেকোনো ফলাফলকে প্রভাবিত করে।
অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ তাদের সহকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতা বড়ায় এবং সকলের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করে। একে অপরের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা এবং বোঝাপড়ার সম্মিলন ঘটায়। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ সময় এবং অর্থের দিক থেকে বিশেষ সাশ্রয়ী। কোর্সের জন্য প্রশিক্ষাণার্থীকে অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা একই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। প্রশিক্ষণের জন্য কাউকে নিয়োগে করার খরচ কমিয়ে দেয়। সবাই তাড়াতাড়ি তাদের কাজে ফিরে যেতে পারেন এবং সময় নষ্ট হয় না । অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন দল ও মতের মতাদর্শের কারণে বিভক্ত হতে পারে। অনেক জায়গায় এটা প্রতীয়মানও হচ্ছে বৈকি।
অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ একই প্রতিষ্ঠানের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ায়। এ প্রশিক্ষণ অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ উন্নত করে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণকে বাস্তবায়নের ক্ষমতা সৃষ্টি হয়, যাতে তারা অন্যান্য সহকর্মীদের উন্নয়ন সহযোগী হতে পারে।
অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ অনেক সময় বোঝা হয়ে যেতে পারে যদি মাঝে মাঝেই এর আয়োজন করা না হয়৷ আবার, অনেকে প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব সহকারে নাও নিতে পারেন। যদি এমনটি ঘটে তবে এই ধরনের প্রশিক্ষণ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যর্থতা এনে দিতে পারে।
এই প্রশিক্ষণের প্রধান সমস্যা হলো প্রশিক্ষণ প্রদানকারীর জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে এবং প্রশিক্ষণের উপকরণসহ একটি প্রশিক্ষণ কোর্স উত্থাপিত করার জন্য বর্ধিত বোঝা তৈরি করে, যা অনেক সময় নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে। প্রশিক্ষণের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কক্ষ এবং প্রশিক্ষাণার্থীদের জন্য সরঞ্জাম, যেমন প্রজেক্টর, ল্যাপটপ এবং প্রশিক্ষণ উপযোগী মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিসও খুব দরকার। এই প্রশিক্ষণ তখনই সার্থক হবে যখন সবাই মনেপ্রাণে এটা মেনে নেবেন এবং স্বীকার করবেন, এই প্রশিক্ষণ আমাদের দরকার এবং আমরা এটা চলমান রাখতে চাই।
মাউশি স্বাক্ষরিত ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের মতো এ রকম একটা প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলো। কিন্তু পার্থক্য হলো ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সব সরকারি-বেসরকারি স্কুলে শেষ করতে বলা ছিলো। সবার মতো আমিও জ্ঞাত নই যে, ইন-হাউজ প্রশিক্ষণ কেনো সীমাবদ্ধতার রশি দিয়ে লাগাম টানতে হবে। পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে সবাই প্রশিক্ষিত নয়, আর এই সমস্যার একমাত্র সমাধান প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে নিজেকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। বছরে একবার সাত দিন বা পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে এতো বড় কর্মযজ্ঞে সমাধান খোঁজা যাবে না।
মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা, শিখনের গতি বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সরকার ‘লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (লেইস)’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা, শিখনের গতি বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাউশি অধিদপ্তর। মাউশি সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে এটিই মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য নেয়া সবচেয়ে বড় প্রকল্প। প্রকল্প ব্যয়ের ৩ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক, আর সরকার দেবে ৪৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছরের অক্টোবর ২০২৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ২০২৮ খ্রীষ্টাব্দ ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
এ প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন। এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৯৫৭ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ পাবেন ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৯০ জন শিক্ষক। আর স্থানীয় প্রশিক্ষণে ভালো ফল করা ১ হাজার ৪৬৭ জন শিক্ষক বিদেশে প্রশিক্ষণ পাবেন। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৫৮ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় ১০ হাজার ৩৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে।
দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রায় ১৯ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন ৮৯ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। তবে স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটির বেশি। মাউশির তথ্য বলছে, মাধ্যমিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে বেশ পিছিয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজি দক্ষতা খুবই খারাপ। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই শিখন-প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে লেইস প্রকল্পটি নেয়া হয়।
এজন্য অবশ্যই রাষ্ট্র এবং মাউশি প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু একটা জিজ্ঞাসা ১ হাজার ৪৬৭ জনের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ৫৮ শতাংশ ব্যয় হবে! যে দেশে নিজেদেরকে সমাজের কাছে একটা সম্মানী পেশার মানুষ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য রাজপথে নামতে হয়। ন্যূনতম বেতন কাঠামো তৈরিতে যুগ যুগ ধরে তপস্যা করতে হয়, সেদেশে ঋণের টাকা মাথায় নিয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণ দৃষ্টিকটু ছাড়া আর কিছু নয়।
তবে সকলের মতো আমিও আশা করি সরকার ও মাউশি অবশ্যই বিবেচনা করবে। বড় পরিসরে প্রশিক্ষণ পরিচালনা না করে ছোট ছোট করে ইন-হাউজ’র মতো করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে ব্যয় সংকোচন করা যাবে, ভালো ফলাফল আশা করা যাবে।
এক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনার যোগ্য বলে আমি মনে করি। সেগুলো হলো-প্রতি উপজেলায় বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষক তৈরি করা, উপজেলা মাস্টার ট্রেইনার দ্বারা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষক দল তৈরি করা, যারা বিভিন্ন সময়ে ইন-হাউস প্রশিক্ষণ পরিচালনায় সহযোগিতা করবেন। প্রশিক্ষকদের সম্মানীর ব্যবস্থা করা, প্রতিমাসে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, প্রশিক্ষাণার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইস সর্ম্পকে স্বচ্ছ ধারণা দেয়া এবং তার ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং শিক্ষকদের ফিল্ড ট্রিপের ব্যবস্থা করা।
যেহেতু প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারী প্রধান শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের বাইরে রয়ে গেছে, প্রশ্ন থেকে যায় শিক্ষা বিস্তরণে তাদের ভূমিকা নিয়ে। ইন-হাউস প্রশিক্ষণের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারলে তাদের জানা ও বোঝার ঘাটতি কমে যাবে। সর্বোপরি একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, ভালো ছাত্র কিন্তু ভালো শিক্ষক নাও হতে পারেন। আবার ভালো শিক্ষক কিন্তু ভালো প্রশিক্ষক নন। ভালো প্রশিক্ষক তৈরি করতে হয়।
লেখক: শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার টেকনিক্যাল অফিসার