বাংলাদেশের মেয়ে সুরাইয়া আক্তার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় থেকে সম্প্রতি পিএইচডি শেষ করেছেন তিনি। তার পিএইচডির বিষয় ছিল ‘প্রতিবন্ধিতা ও বাংলাদেশের নারী’। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরই মধ্যে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি।
সুরাইয়া আক্তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীও ছিলেন তিনি। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী মিজানুর রহমান ও এক সন্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন সুরাইয়া আক্তার। তার স্বামীও যুক্তরাষ্ট্রের একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে পিএইচডি শেষ করেছেন। শনিবার (১৭ নভেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মানসুরা হোসাইন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন সুরাইয়া আক্তার। সেখান থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন তিনি। সুরাইয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছেন—এমন ব্যক্তিরা তাঁদের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে আমিই প্রথম পিএইচডি করলাম। আর এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আমিই প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হিসেবে পিএইচডি শেষ করলাম। আমি প্রথম কি না জানি না, তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আমি পিএইচডি শেষ করতে পেরেছি, সেটাই বড় কথা।’
সুরাইয়া আক্তার রেটিনার সমস্যায় ভুগছেন। চার বোনের মধ্যে তার আরেক বোনও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সুরাইয়া জানান, ঘরের মধ্যে আলো জ্বালানো থাকলে তিনি হয়তো বুঝতে পারেন তার সামনে একটি বিছানার চাদর আছে, তবে তার প্রিন্ট বা নকশা বুঝতে পারেন না। আস্তে আস্তে সামনের সবকিছু ধূসর থেকে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি এ সত্যকে মেনে নিয়েছেন। প্রতিবারই ‘আমি পারব’—এটি প্রতিষ্ঠিত করেই তাঁকে এগিয়ে যেতে হয়েছে।
ছোট ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে পিএইচডি শেষ করতে পারার পেছনে স্বামী মিজানুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সুরাইয়া। তিনি জানান, পিএইচডি শেষ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার স্বামীর চাকরি হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকেও একটি চাকরির প্রস্তাব দিয়েছে। তবে আপাতত ছয় মাস তিনি তার দুই ছেলেকে সময় দেবেন। বড় ছেলের বয়স সাড়ে আট বছর আর ছোট ছেলের বয়স আড়াই বছর।
সুরাইয়া আরও জানান, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে তার স্বামী শিকাগোর ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হলেও তিনি সে বছর ভর্তি না হয়ে পরের বছর ভর্তি হন। এই সময়ে তিনি তাঁকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করেন। তারপর দুজন একসঙ্গেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে পিএইচডি করতে আসেন।
সুরাইয়া বলেন, ‘পিএইচডি করতে গিয়ে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। সুপারভাইজারের বকা খেয়ে কিছুদিন পরপরই মনে হতো, আর পড়াশোনা করব না। পরে স্বামী বুঝিয়ে আবার শান্ত করতেন। ছোট ছেলের জন্মের পর প্রসবপরবর্তী জটিলতায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বেশ কিছু দিন থেরাপি নিতে হয়ে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী করোনা শুরু হয়। তবে করোনার কারণে আমরা দুজন বাসা থেকেই পিএইচডির সব কাজ শেষ করতে পারি। এটা আমাদের জন্য ছিল বাড়তি পাওয়া।’
সুরাইয়া জানান, পিএইচডির আওতায় বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত লেখাগুলো তিনি বিশ্লেষণ করেন। ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধী নারীদের প্রজননস্বাস্থ্য এবং এ স্বাস্থ্য নিয়ে নারীদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টিতে কাজ করতে চান।
স্ত্রী সুরাইয়া আক্তারের পিএইচডি শেষ করার পর স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠানের ছবি পোস্ট করে মিজানুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, বিয়ের প্রথম দিনই স্ত্রীর কাছে স্ত্রীর স্বপ্নের কথা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, তার বাবা খুব খুশি হবেন যদি তিনি বিশ্বের নামকরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করতে পারেন। মিজানুর লিখেছেন, সেই দিনই তিনি তার স্ত্রীর এই স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। এখন স্ত্রীর সেই স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধিতা উন্নয়নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. নাফিসুর রহমান বলেন, ‘আমার জানা মতে, সুরাইয়া শুধু প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে নয়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যেও প্রথম, যিনি দেশের বাইরে বিশ্বের নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করলেন। এটি বাংলাদেশের জন্যও অনেক বড় পাওয়া।’
সুরাইয়া-মিজানুর দম্পতির পরিচয় হয় প্রতিবন্ধিতা সূত্রেই। প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন তার স্বামী মিজানুর রহমান। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে গড়ে তোলেন ফিজিক্যালি–চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের কাজের মধ্যে রয়েছে সমাজের স্বাভাবিক মানুষদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিডিএফের কমিটি কাজ করছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য। মিজানুর রহমান ছিলেন এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। যুক্তরাষ্ট্রেও সংগঠনের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
পিডিএফের কাজের সূত্রেই সুরাইয়া আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মিজানুর রহমানের। মিজানুরও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। নানা প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুরাইয়াকে বিয়ে করেন। স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষ শেষ করে বিয়ে, তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় প্রথম সন্তানের জন্ম। তারপর পিএইচডি করতে গিয়ে ছোট ছেলের জন্ম। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ জুলাই এই পরিবার বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় সংসার সাজানোর কাজে ব্যস্ত এ দম্পতি।
নীলফামারীর মেয়ে সুরাইয়া। তিনি জানান, দেশে থাকা বাবা মকবুল হোসেন ও মা রাশেদা বেগম রয়েছেন। মেয়ে-জামাতার পিএইচডি শেষ করার খবরে তারা খুব খুশি হয়েছেন।
সুরাইয়া ফিরে গেলেন তার ছোটবেলায়। বলেন, নীলফামারীতে তখন স্বাভাবিক মেয়ে বাচ্চাদের পড়াবেন কি না, তা–ই নিয়ে অভিভাবকেরা চিন্তা করতেন, সেই জায়গায় প্রতিবন্ধী মেয়েকে পড়াবেন, সে চিন্তা করাটা কঠিন ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘পড়াশোনার প্রতি ধাপে আমি পারব, তা প্রমাণ করতে হয়েছে। আমাকে একটিবার সুযোগ দেওয়া হোক, সে আবেদন করতে হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির সদস্যরা আমার মা–বাবাকে বুঝিয়ে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় পাঠান। এ সংগঠন থেকেই এসএসসি পরীক্ষার পর প্রথম ব্রেইল শিখি। আস্তে আস্তে মা–বাবা আমার পড়াশোনার গুরুত্বটা বুঝতে শুরু করেন।’
দেশে থাকার সময় সুরাইয়া উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক শারীরিক প্রতিবন্ধী আশরাফুন নাহার মিষ্টির প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান সুরাইয়া। আর পিডিএফ তো তার জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে।
বাংলাদেশে ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পড়াশোনার বিষয়ে বলতে গিয়ে সুরাইয়া বললেন, ‘বাংলাদেশে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে পদে পদে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তুমি প্রতিবন্ধী, তুমি এটা পারবে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করলাম, সেখানে প্রতিবন্ধিতা–বিষয়ক রিসোর্স সেন্টার আছে। আমার প্রতিবন্ধকতার জন্য কার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে, তা সবই ছিল রিসোর্স সেন্টারের দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়, ফুটপাতসহ সব জায়গায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। আমি প্রতিবন্ধী, তার দায় আমার না।’
সুরাইয়া বলেন, ‘দেশে আমি সাদাছড়ি ব্যবহারে লজ্জা পেতাম। বিভিন্ন আড্ডা এড়িয়ে যেতাম মানুষের বাজে মন্তব্য শুনতে হবে বলে। আর এখানে আমি সাদাছড়ি হাতে নিয়ে চলাফেরা করতে গর্ববোধ করি। ছেলেকে স্কুলবাস থেকে নামিয়ে বাসায় ফেরা, চিকিৎসকের কাছে যাওয়া—এ কাজগুলো একাই করতে পারছি। অথচ বাংলাদেশে এই কাজগুলোর জন্যও অন্যের ভরসায় চলতে হতো। এখানে চলতে গিয়ে আমি রাস্তার মাঝখানে চলে গেলে গাড়িগুলো আমার জন্য থেমে যাচ্ছে, কেউ না কেউ আমার পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। আমি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তা নিয়ে এখন আর কোনো গ্লানি নেই।’
স্বামী মিজানুর রহমান সব সময় সুরাইয়ার পাশে থাকছেন। দুই ছেলে মাকে কতটুকু বুঝতে পারে—এ প্রশ্নে সুরাইয়া বলেন, ‘শুধু আমার দুই ছেলে নয়, আমার বোনের বাচ্চারাও কীভাবে যেন বুঝে গিয়েছিল আমার সীমাবদ্ধতার কথা। আমার আড়াই বছর বয়সী ছোট ছেলেও তার কিছু লাগলে বা শরীরের কোনো জায়গায় সমস্যা হলে আমার হাতটি নিয়ে সেখানে ধরে তা বোঝানোর চেষ্টা করে।’
দেশে ফিরবেন কি না—এ প্রশ্নে কিছুটা থামলেন সুরাইয়া। বলেন, ‘পিএইচডি করে দেশে ফিরলেও হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানের রিসেপশনিস্ট হিসেবে চাকরি পাব, এর বেশি কিছু তো হওয়া সম্ভব নয়। তাই আপাতত দেশে ফেরার ইচ্ছা নেই। তবে প্রতিবন্ধিতা, প্রতিবন্ধী নারীর অধিকার রক্ষা—এসব বিষয় নিয়ে সব সময় কাজ করে যাব।’