ইরানের সাম্প্রতিক হামলার জবাব হিসেবে একই সঙ্গে ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের পরমাণুকেন্দ্রের আশপাশেও বিস্ফোরিত হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ইরান এ হামলার কথা স্বীকার করেনি। বরং ইরান জোর গলায় দাবি করেছে, তাদের পরমাণু স্থাপনা অক্ষত রয়েছে এবং বাইরের কোনো দেশ থেকে ইরানে হামলা হয়নি। গত শুক্রবার ইরানের পরমাণুকেন্দ্রের আশপাশ থেকে যে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, সেটি ইসফাহানে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করার ফলে বিস্ফোরণের শব্দ।
ইরানের দাবির পক্ষে কথা বলেছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ। সংস্থাটি বলেছে, ‘ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলো অক্ষত রয়েছে।’
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, আমেরিকা বলেছে, ইরানে ইসরায়েল হামলা করেছে। ইরান বলছে, কোনও হামলা হয়নি। আর ইসরায়েল এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্যই করেনি।
বিস্ফোরণের শব্দ
গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। ওই হামলার জবাবে গত ১৩ এপ্রিল শনিবার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)। এরপর ইসরায়েল প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা চালাবে কি না, ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)–এর পারমাণবিক কমান্ডের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ হাগতালাব ইসরায়েলের উদ্দেশ্য হুংকার দেন। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর দিকে আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র তাক করা রয়েছে এবং ‘‘ট্রিগারে আঙুল’’ রাখা আছে।’
তাঁর এ হুংকারের পরদিনই ইরানের ইসফাহানে পারমাণবিক কেন্দ্রের আশপাশে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। এখানে ইসরায়েলি হামলা হয়নি বলে দাবি করলেও ইরান সরকার তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে। এমনকি নিরাপত্তার খাতিরে পরমাণুকেন্দ্রে এক দিনের জন্য কাজ বন্ধ রাখারও ঘোষণা দিয়েছে ইরান সরকার।
ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে কি না, সেটি স্পষ্ট না হলেও এটি স্পষ্ট যে, শুক্রবার ইরানের নাতাঞ্জ এলাকার কাছাকাছি হামলা হয়েছে। স্বভাবই প্রশ্ন উঠেছে, ইসরায়েল কি ইরানের পরমাণু স্থাপনায় সরাসরি হামলা চালাতে পারবে কি না।
সত্যিই কি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করা সম্ভব?
ইসরায়েল যদি এ ধরনের হামলা চালাতেই চায়, তবে তাকে একাই এ হামলার দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ ইসরায়েলের প্রধান মিত্র আমেরিকা এরই মধ্যে সাফ বলে দিয়েছে, তারা ইরানের ওপর ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলার সঙ্গী হবে না। যদিও ইরান যখন ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল, তখন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছিল আমেরিকা।
এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকার প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়াই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো ইসরায়েলের পক্ষে কঠিন হবে। কারণ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাটি পাহাড়বেষ্টিত দুর্গম এলাকা নাতাঞ্জে অবস্থিত। এমনকি স্যাটেলাইট চিত্রগুলো বলছে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ পরমাণু কেন্দ্রটি মাটির নিচে অবস্থিত। এমন একটি ভূগর্ভস্থ জায়গায় হামলা চালাতে হলে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কয়েকটি স্তর ভেদ করে হামলা চালাতে হবে। স্পষ্টতই এটি একটি দুঃসাধ্য কাজ।
আল জাজিরার বিশ্লেষক মাজিয়ার মোতামেদি বলেন, ‘ইরানের পরমাণুকেন্দ্রটি ভূপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ৩২৮ ফুট গভীরে অবস্থিত। এত গভীরে গিয়ে মার্কিন বাঙ্কার বাস্টার বোমাগুলোও কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির লাগাম টেনে ধরতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের এই ইহুদি রাষ্ট্র বলেছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করতে প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না ইসরায়েল। ইরান অবশ্য বরাবরই বলে আসছে, তারা পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে না।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি চুক্তি থেকে একতরফাভাবে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে আমেরিকা। তাতে অবশ্য ইরান বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন হয়নি। বরং ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তারা তাদের পারমাণিক কার্যক্রম আরও বাড়িয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে নাতাঞ্জে নতুন করে পরমাণুকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে ইরান। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে নাতাঞ্জে একটি হামলা হয়েছিল, যে হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছিল ইরান এবং ওই হামলার পর ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ৬০ শতাংশে উন্নীত করে।
তবে আইএইএ তাদের শেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ৬০ শতাংশে উন্নীত করলেও কর্মসূচিটির গতি মন্থর হয়েছে। তবে তাদের হাতে বোমা তৈরির মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে।’
এসব তথ্য–উপাত্ত থেকে স্পষ্টতই ধারণা করা যায়, ইসরায়েল যদি ইরানের পরমাণু স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালায়, তবে ইরান নিঃসন্দেহে আরও কঠোর হবে। তারা পরমাণু অসম্প্রসারণ চুক্তি থেকে বরে হয়ে যেতে পারে এবং বোমা তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।
ইসরায়েলি হামলার কারণে আরও যেসব সম্ভাব্য ক্ষতি হতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা। নাতাঞ্জ একটি পাহাড়বেষ্টিত ঘন সবুজ প্রাকৃতিক এলাকা। সেখানে হামলা হলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া এই অঞ্চলে হামলার মাধ্যমে ইরানের সকল পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রকল্প পরিচালকদের হত্যা করা সম্ভব হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। পরমাণু কেন্দ্র হয়তো ধ্বংস করা যাবে, কিন্তু তাদের জ্ঞানকে তো আর ধ্বংস করা সম্ভব হবে না।
গুরুতর ও অপ্রত্যাশিত প্রভাব
ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে ইসরায়েলি হামলার অর্থ হচ্ছে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করা। কারণ এটি ইরানের সর্বোচ্চ মূল্যবান রাষ্ট্রীয় স্থাপনা। এর ওপর সামান্যতম আঘাতও বরদাস্ত করবে না ইরান। তা ছাড়া ইসরায়েল যদি প্রতিশোধ নিতেই চায়, তবে তা নৈতিকভাবেও বৈধতা পায় না। কারণ ইরানের হামলার আগে সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল যে সাত জন ইরানি সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে, সেটি সুস্পষ্টভাবেই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
তারপরও ইসরায়েল যদি একগুয়েমি করে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালায়, তখন ইরান সমর্থিত সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও সংঘবদ্ধভাবে ইসরায়েলের বিপক্ষে যুদ্ধে নামবে। আখেরে সেটি গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে।
এমনিতেই গাজায় যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র তোপের মুখে রয়েছে ইসরায়েল। এরপর নতুন করে আরেক হঠকারি সিদ্ধান্তের কারণে যদি গোটা মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত হয়ে পড়ে, তার জন্য ইসরায়েলকে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না। ইসরায়েরেল ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও তখন সরাসরি ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াতে পারবে না।
তারপরও ইসরায়েল যদি জেদের বসে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, সেটি হবে নিঃসন্দেহে আত্মঘাতি এবং নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার শামিল।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, মেহের নিউজ, রয়টার্স ও এএফপি