উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে চাই কার্যকর স্বতন্ত্র কমিশন

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী |

উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাগাদা দিয়ে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অনেকদিন ধরে এ দেশের উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধিকল্পে শেখ হাসিনার চিন্তা-চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক আদর্শকে সমন্বয় সাধন করে শিক্ষার জন্য আদর্শ ও গবেষণানির্ভর শিক্ষকমণ্ডলীর বিকাশে নানামুখী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের কর্মসম্পাদন আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্তভাবে করার জন্য শিক্ষকদের মান-সম্মানকে একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার নং ১০ (১৯৭৩)-এর মাধ্যমে স্থাপিত হয়।

এটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন নিরঙ্কুশ করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুসারে অর্থ সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া। প্রতিষ্ঠাকালে ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, যার মধ্যে চারটি সাধারণ বিষয়ে, আর দুটির মধ্যে একটি হচ্ছে কৃষিভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যটি প্রকৌশলবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপান্তর প্রয়োজন, যা কিনা আমলাতন্ত্রমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে তিনি কখনো চাননি আমলারা এসে শিক্ষকদের মর্যাদাহানি করুক। বিশ্ববিদ্যালয় যে উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে কাজ করছে (নতুন জ্ঞান সৃষ্টি), সেটি যেন বজায় থাকে, সেজন্য জাতির পিতার গভীর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যেমন আজীবন শিক্ষকদের সম্মান করেছেন, তেমনি তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও শিক্ষকদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেন। কয়েকদিন আগে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে ড. আনিসুজ্জামানের চাদর পরম মমতাময়ী কন্যার মতো জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ঠিক করে দিতে দেখে নেত্রীর ওপর শ্রদ্ধায় মন ভরে গেল। শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করতে বারবার একটি মাফিয়া নেক্সাস কাজ করছে। তবে শিক্ষকরা যেন তাদের মান-মর্যাদা ঠিক রাখেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার আলো চারদিকে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট রয়েছেন। ফলে এখন ৪৯টি সরকারি ও ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও মূল অধ্যাদেশে চেয়ারম্যান ও পূর্ণকালীন দুজন সদস্য ছিলেন, এখন সেখানে পাঁচজন পূর্ণকালীন সদস্যের কথা সংশোধন করা হয়েছে। লোকবল সংকট সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন তিন বছরের বেশি সময় ধরে জনবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এটি অবশ্যই বর্তমান চেয়ারম্যানের মুক্ত চিন্তা এবং জননেত্রীর আদর্শকে বাস্তবায়নে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার সুফল। তবে ধারাবাহিকভাবে এখন উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে আমলাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিক হারে বাজেট বরাদ্দ দেয়ার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং গুণগত মান বৃদ্ধি ও ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তা সত্যি প্রশংসনীয়। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলোয় সনদ বাণিজ্য ছিল বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, সেগুলোকে সঠিক পন্থায় পরিচালনার ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে ইউজিসি। উচ্চশিক্ষা মান উন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) আওতায় ২ হাজার কোটি টাকার কার্যক্রম, যার অর্থায়নে ছিল বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকার, সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনা রিপোর্ট অনুসারে দেখা যায়, ৯৯ দশমিক ২০ শতাংশে প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে, যা এ দেশের অন্য কোনো প্রকল্প এ-যাবৎ অর্জন করতে পারেনি। প্রকল্পের ফলস্বরূপ ৬৯টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে আগামী পাঁচ বছরে তা বাস্তবায়নের পদ্ধতিগত ও লাগসইভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এদিকে হেকেপের অন্যতম কার্যক্রমের আওতায় গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য ১৯টি শিল্প চাহিদামুখী উদ্ভাবনী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এতে প্রাপ্ত ফলাফলে নয়টির মতো আন্তর্জাতিক পেটেন্ট পাওয়ার জন্য এরই মধ্যে আবেদন করা হয়েছে।

বস্তুত শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষমতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন নিজেদের দক্ষতা সম্প্রসারণ করতে পেরেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় সংস্থাটি চারটি সরকারি, চারটি বেসরকারি ও একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় আইটিইউ প্রতিষ্ঠান সহায়তা প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জার্মান সরকার জিটিজেটের আওতায় ১৫০ মিলিয়ন ইউরো অনুদান দিচ্ছে। উপরন্তু, ৩০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের HEAT নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শিক্ষার মান উন্নয়নে রিজিওনাল কো-অপারেশনের আওতায় নানামুখী পদক্ষেপ, বিশেষত উন্নত শিক্ষা ও নারীদের শিক্ষার মান বৃদ্ধিকল্পে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। তবে হিট প্রকল্প বাস্তবায়নে শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, যাতে ১০ বছর মেয়াদি শিক্ষা ক্ষেত্রে স্ট্যাট্রেজিক প্ল্যান তৈরি করে বাস্তবায়ন করা যায়। এক্ষেত্রে ভারতের এমটিসি প্রোগ্রামের প্রফেসর ভোলানাথ দত্তকে কাজে লাগানো যায়।

এদিকে তুরস্কের সরকার টেক্সটাইল ক্ষেত্রে ২০টি পিএইচডি ডিগ্রির স্কলারশিপ দিচ্ছে। অস্ট্রিয়া-সুইজারল্যান্ড উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার কোয়েকার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশে বিকাশমান উচ্চশিক্ষা এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট রয়েছে। বর্তমান সরকারপ্রধান যেখানে আগামী পাঁচ বছরে ১ দশমিক ২৮ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছেন, সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন তার দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস এরই মধ্যে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট ও মাস্টার্স ইন ইকোনমিকস (উদ্যোক্তা অর্থনীতি) চালু করেছে। এ প্রতিষ্ঠানে ইউজিসির প্রকল্পের আওতায় ইকোনমিক ইনকিউবেটর স্থাপন করার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সৃজনশীল ও কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থায়ন করে উদ্যোক্তা সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প নেই। এজন্য উদ্যোক্তা আরো প্রয়োজন।

এদিকে ইউজিসি গবেষণার মান বৃদ্ধিকল্পে ২০০৯ সালে যেখানে ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল, তা বাড়িয়ে ২০১৮ সালে ৩ দশমিক ৮০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তবে দেশ-বিদেশের আলোকে গবেষণা ক্ষেত্রে অধিক অর্থায়ন দরকার। জাতি হিসেবে আমাদের বৈশ্বিক পটভূমিতে মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য গবেষণা ক্ষেত্রে আরো জোর দিতে হবে। আমলামুক্ত পরিবেশে বৈশ্বিক পর্যায়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।

এদিকে সরকারপ্রধান তিন বছর ধরে ‘বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন’ তৈরির নির্দেশনা দিয়ে এসেছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। তবে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সচিব কমিটি শিক্ষকদের ওপর আমলাদের ছড়ি ঘোরানোর জন্য সুপারিশ করেছে। সচিব কমিটির এ সুপারিশ বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রীর নির্দেশনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ফলে আমলাদের হাত থেকে উচ্চশিক্ষা বাঁচাতে হবে। অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন, এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এ ধরনের সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে চরম অসন্তোষ দেখা দেবে।

এক্ষেত্রে সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুরোধ করব উচ্চশিক্ষা যেন আমলাদের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যমুক্ত হয়। কেননা একজন প্রকৃত শিক্ষকই পারেন দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিতভাবে কাজ করতে। উচ্চশিক্ষা কমিশন যেন আমলামুক্ত থাকে, সেজন্য বিশেষ পরামর্শ থাকল।

 

লেখক: ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক

 

সৌজন্যে: বণিক বার্তা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027840137481689