উচ্চশিক্ষায় 'বর্ণাশ্রম' প্রথা!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমার এক ছাত্রী, বর্তমানে নতুন চালু হওয়া একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক, আমাকে প্রশ্ন করেছে- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করে বা সেখান থেকে পাস করে বেরোয়, শুধু তারাই কি মেধাবী? অন্যরা, যেমন যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে পড়াশোনা করে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়, তারা কি সবাই কম মেধাবী? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বা সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ফলের কি কোনো মূল্য বা গুরুত্ব নেই? তাহলে কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাইরের প্রার্থীদের হীনভাবে দেখা হয়? হয় যে- এ কথা তো সত্যি? প্রশ্ন করেছে, 'স্যার, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?' আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা বা সেখান থেকে পিএইচডি করলেও, দীর্ঘ সময় বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছি। কয়েক বছর একটি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়েছি। নানা বিষয়ের মধ্যে শিক্ষা নিয়েও লিখি, কথা বলি, ভাবনাচিন্তা করি। ছাত্রীটির দাবি বা আবদার তাই আমার কাছে, আমি যেন তার প্রশ্নটির জবাব দিই; বিষয়টি নিয়ে অন্তত কিছু লিখি। সোমবার (২৮ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

বিষয়টি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা ও অভিমত দেওয়ার আগে আমি ছাত্রীটির দীর্ঘ চিঠির কতকাংশ তুলে দিচ্ছি। সে লিখেছে, 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যদি বিসিএস পরীক্ষার ফলে প্রথমদিকে স্থান করে নিতে পারে; প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ লাভ করে তাদের মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারে; তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকে একটা বড় যোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা হবে কেন? এমন নিয়ম বা শর্তের কথা কি কোথাও লেখা আছে? আমি যতদূর জানি, নেই। আর যদি থাকে, তবে তার পক্ষে যুক্তি কী? এবং তা ন্যায়সঙ্গত কি-না।'

ছাত্রীটি আরও প্রশ্ন করেছে, 'এই আচরণের মধ্য দিয়ে আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি আসলে এক ধরনের বর্ণবাদী মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছে না? এভাবে কি শিক্ষা ও গবেষণা, মেধা ও মননচর্চার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের মতো একটা বৈষম্যের দেয়াল তোলা হচ্ছে না? এর দ্বারা দেশ বা জাতি কি কোনোভাবে উপকৃত হচ্ছে? মেধার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে?' সে লিখেছে, 'এ কথা সত্য যে, পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার পরিবেশের দিক থেকে যে অবকাঠামোগত ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, অধিকাংশ বেসরকারি কলেজে ও অনেক সরকারি কলেজে তা নেই। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি কলেজগুলোয় যারা শিক্ষকতা করেন, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সেই শিক্ষকরা জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার (লিখিত ও মৌখিক) মধ্য দিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের অনেক ধাপ পেরিয়ে তবেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। উপরন্তু তাদের অনেকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া ও গবেষণার অভিজ্ঞতাও থাকে। কাজেই শিক্ষক হিসেবে তাদেরকে কম যোগ্য মনে করার কোনো কারণ নেই।'

ছাত্রী কতগুলো যৌক্তিক প্রশ্নই তুলেছে, যার উত্তর আমার কাছে নেই। প্রশ্নগুলোর কিছু আমারও এবং হয়তো আরও অনেকেরই। কিংবা আমরা আসলে এভাবে কখনও বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখিনি। আমার ধারণা ও অভিজ্ঞতা থেকে আমি শুধু এখানে কয়েকটা কথা যোগ করতে চাই। যতদূর জানি বা মনে করতে পারি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিরসন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চাপ কমানোর আশু লক্ষ্য থেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সে উদ্দেশ্য যে কতক পরিমাণে অর্জিত হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। এর অতিরিক্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যে দরকারি আরেকটা কাজ করে তা হলো, সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের আয়োজন, শিক্ষকতা ও শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে যা সহায়ক। সেটা এ যাবৎ কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে তা আলাদা বিচারের বিষয়। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মানোন্নয়নে কি অনুরূপ কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে? ক্লাসরুমে পাঠদানের অভিজ্ঞতাই কি এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট?

এ কথা ঠিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর সারাদেশেরই শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার। তার মধ্যে অনেক কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই থাকে অগ্রাধিকারের শীর্ষে। কিন্তু সবার সে সুযোগ ঘটে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে না কিংবা দিয়েও অকৃতকার্য হয়, তারা এর পর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সুযোগ পায় না এবং তাদের মধ্যে যারা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, যাদের অভিভাবকদের সঙ্গতি নেই তাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর, তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কোনো সরকারি বা বেসরকারি কলেজে ভর্তি হয়। সাধারণভাবে এ কথাটা সত্যি, কিন্তু সর্বাংশে নয়। পারিবারিক কারণ, সামাজিক বাস্তবতা ইত্যাদি বিবেচনায়ও এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদেরও একটা অংশ বাড়ির কাছে বা নিজ জেলার সরকারি বা বেসরকারি কলেজে ভর্তি হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের নিরাপত্তা ভাবনাও এর পেছনে কাজ করে। এখন যে ছাত্র বা ছাত্রীটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে হয়তো জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বা কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, আমরা কি স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেব- সে ছাত্র হিসেবে খারাপ এবং তার অন্য যে কোনো চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা থাক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই? কিংবা হলেও শুধু নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক হতে পারবে? যত ভালো ফলই থাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবে না? কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারী যত ভালো ফলেরই অধিকারী হোক, সেটা কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে না? কিন্তু সে রকমই একটা অলিখিত নিয়ম যেন দাঁড়িয়ে গেছে।

দীর্ঘ সময় সরকারি কলেজে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, কয়েক বছর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো এবং সেই সূত্রে ছাত্রছাত্রীদের মৌখিক পরীক্ষা, প্রশ্নপত্র মডারেশন, বেসরকারি কলেজের নিয়োগ পরীক্ষা ইত্যাদিতে একসঙ্গে কাজ করার সূত্রে আমার যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার ভিত্তিতে বলতে পারি, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে (নিশ্চয় সবাই নন) এক ধরনের উচ্চম্মন্যতা বা আসলে সংকীর্ণতায় ভোগেন। কারও কারও বেলায় যার প্রকাশ বেশ খোলামেলা ও নিষ্ঠুরভাবেই ঘটে। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাদের সচেতন বা অবচেতন উপেক্ষা বা অবহেলার শিকার হন। আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু সমদর্শী আচরণ পাওয়া যায় না, তাই নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের যথেচ্ছ ফার্স্টক্লাস দিয়ে সে উপেক্ষার শোধ নেওয়ার 'যুক্তি'ও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মুখেই আমি শুনেছি। এ ছাড়া নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগনীতি এমনভাবে তৈরি হচ্ছে, যাতে সরকারি কলেজের মেধাবী শিক্ষকরাও, যোগ্যতার সব শর্ত পূরণ করে, বিশেষ করে সিনিয়র পর্যায়ে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানে উৎসাহী না হন। কারণ সে ক্ষেত্রে বিরাট আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি তারা নিতে পারেন না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তথা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই উচ্চশিক্ষায় এই বর্ণাশ্রম প্রথার অবসান ঘটানো কর্তব্য। কিন্তু এখানেও সেই পুরোনো কথা- বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

লেখক: মোরশেদ শফিউল হাসান, শিক্ষাবিদ ও গবেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036849975585938