উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথে ফেরদৌসির বাধা আর্থিক অস্বচ্ছলতা

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি |

অশিক্ষার অন্ধকারে যেখানে দিনের আলোতেও মানুষের দৃষ্টিভ্রম হয়, সেই গ্রাম থেকে প্রতিবন্ধকতা জয় করে এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেও ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে জান্নাতুল ফেরদৌসির স্বপ্ন। আর্থিক সংকটের কারণে ফেরদৌসি অংশ নিতে পারেনি কলেজের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায়। কেনা হয়নি দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ্যবই। অথচ পটুয়াখালীর কলাপাড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজের এ ছাত্রীর স্বপ্ন ছিল প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল ভেঙ্গে সে একাই লড়বে অশিক্ষার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, বিদ্যুতের আলো না পৌঁছলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় এনে আলোকিত করবে গোটা গ্রাম।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া-আমতলী সীমান্তবর্তী চাকামইয়া ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া আবাসন কেন্দ্রে ১৬০টি পরিবারের বসবাস। একযুগেরও বেশি সময় ধরে সহায়-সম্বলহীন এ পরিবারগুলোকে সরকার এখানে পুনর্বাসন করে।  প্রথম দিকে সকল আধুনিক সুবিধা থাকলেও ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে সিডরের তা-বের পর আবাসন কেন্দ্রগুলোতে ফুটে উঠে বেহাল দশা। শহরকেন্দ্রিক এ আবাসন কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও এখনও বিদ্যুৎ সুবিধা পায়নি এখানকার পাঁচ শতাধিক মানুষ। স্যানিটেশন ব্যবস্থা এখন প্রায় শূণ্যের কোঠায়। কারণ সরকার নির্মিত ১৬টি টয়লেট এখন রোগজীবাণু সৃষ্টির কারখানা। সরেজমিনে এ আবাসন কেন্দ্র ঘুরে এ দুর্ভোগ ও মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র দেখা যায়।

সরকার শিক্ষার মান উন্নয়ন ও স্কুলে শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও নিশানবাড়িয়া আবাসন কেন্দ্রের শূণ্য থেকে ১০ বা এর বেশি বয়সের স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ আবাসন কেন্দ্রের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। নতুন প্রজন্মের কিছু শিক্ষার্থী পড়ালেখায় আগ্রহী হলেও তাদের যেতে হচ্ছে মাদরাসায় যা প্রায় দুই কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। এ কারণে অশিক্ষার অন্ধকারে থাকা এ আবাসন কেন্দ্রের একমাত্র ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসি মাধ্যমিকের গ-ি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলেও অন্য পরিবারগুলোর মতো আর্থিক সংকটে তারও শিক্ষাজীবন থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

মাছ বিক্রেতা রানা মুন্সীর তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে ফেরদৌসি। সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে তাঁর জন্ম হলেও বাবা-মায়ের অসচেনতায় গ্রাম্য ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় দুই মাস বয়সে বাম চোখের দৃষ্টি হারাতে হয়েছে ফুটফুটে ফেরদৌসিকে। দৃষ্টি হারানোর সাথে সাথে সঠিক চিকিৎসার অভাবে চোখটি ক্রমশ ছোট হতে থাকে। বাবা-মায়ের অসচেতনতায় শৈশবে এক চোখের দৃষ্টি হারানো ফেরদৌসি দারিদ্র্যতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়।

কিন্তু যে আবাসনে সবাই অশিক্ষার বেড়াজালে বন্দি, সেখানে শিক্ষার আলো ফোটানো এক ফেরদৌসির পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। একা প্রতিদিন প্রায় ছয় কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে কলেজে আসলেও বছর শেষে আর পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি সে। আর্থিক সংকট আর নিদারুণ দারিদ্র্যতা অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরায় প্রথম বর্ষেই বন্ধ হওয়ার উপক্রম ফেরদৌসির লেখাপড়া।

জান্নাতুল ফেরদৌসি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শিখে চাকরি করব। ছোট দুই ভাই-বোনের সাথে প্রতিবেশীদের ছেলে-মেয়েদেরও লেখাপড়া শেখাব। কিন্তু তাদের কীভাবে শেখাব, আজ তো আমার পড়ালেখাই বন্ধ। টাকার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি। এরচেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে? এক চোখেই বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অন্য সবার মতো আমাকেও অশিক্ষার অন্ধকারের কূপে ঝাপাতে হলো শুধু আর্থিক কষ্টে।
 
ফেরদৌসির মা মাসুমা বেগম নিজের ভুলের কারণে মেয়ের চোখ হারানোর কষ্টে এখনও গুমরে কাঁদেন। সেই ভুল শোধরাতে নিজে সেলাই মেশিন চালিয়ে এত বছর মেয়েকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার চেষ্টা করলেও আজ সে নিজেও পরাজিত। তিনি বলেন, যেখানে দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতে রাত-দিন পরিশ্রম করতে হচ্ছে, সেখানে কলেজে তিন-চার হাজার টাকার বেতন, পরীক্ষার ফি কীভাবে দিবো। তাই পরীক্ষায় অংশ নেয়া হয়নি জান্নাতুলের। বই কেনা হয়নি দ্বিতীয় বর্ষের। কারণ ওর বাবা মাছ বিক্রি করে  পাঁচ সদস্যের পরিবারের মুখে অন্ন জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছে। 

জান্নাতুলের প্রতিবেশীরা জানায়, এই গ্রামে (আবাসনে) প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোলেই বেশিরভাগ মেয়েকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। সেখানে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জান্নাতুল কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু টাকার জন্য মেয়েটা পরীক্ষা দিতে পারেনি। ও ছিল গোটা আবাসনের গর্ব। কিন্তু অশিক্ষা ও আর্থিক দৈন্যতায় একমাত্র জ্বলতে থাকা শিক্ষা তারাটিও খসে পড়লো এখান থেকে। এখন যদি কেউ ওকে সহযোগিতা করে তাহলেই সম্ভব হবে পরীক্ষায় অংশ নেয়া, নতুন বই কেনা।

এ ব্যাপারে কলাপাড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. সাইদুর রহমান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, তাঁর কলেজে টাকার জন্য মেয়েটি (জান্নাতুল) দুটি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি, বিষয়টি দুঃখজনক। তিনি সাংবাদিকদের কাছে খবর পাওয়ার পরই পরবর্তী পরীক্ষায় মেয়েটিকে অংশ নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন। ফেরদৌসি যাতে শিক্ষা ভাতা পায় সে ব্যবস্থাও করবেন বলে জানান তিনি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055689811706543