উচ্চ শিক্ষার শিক্ষক

মিলু শামস |

বছর কয়েক আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নানা ধরনের দুর্নীতির জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। সে সময় মিডিয়া বেশ কিছুদিন এ নিয়ে সরব ছিল। সেই ভিসির স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল একটি অনুষ্ঠানে।

সারাক্ষণ অন্যের সমালোচনা আর নিজের সম্পদ-বিলাসিতার বহুমুখী বর্ণনায় মুখর থাকতেন ভদ্রমহিলা। যারা তাকে ঘিরে তার সমালোচনামুখর কথা উপভোগ করত তাদের আচরণ দুর্বোধ্য লাগতো। তাদের মধ্যে কি ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা বলে কিছু নেই? পরে বুঝেছি। মনোস্তাত্ত্বিক রহস্যময়তা রয়েছে আসলে এই সমাজের গভীরে। অন্যের শ্রমের ওপর দাঁড়ানো সমাজে যারা নিজেদের শক্তি সংহত করার অবিরাম প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত- ওই ভিসি, ভিসির স্ত্রী এবং তাকে ঘিরে থাকা তোষামোদকারীরা তাদেরই প্রতিনিধি।

তবে সব ভিসি নিঃসন্দেহে এই ভিসির মতো নন। যেমন সব শিক্ষক নন বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতির মেনিফেস্টো-ধারক। তার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির সঙ্কীর্ণতা মাঝে মাঝেই ভয়াবহভাবে প্রকাশ পায়। শিক্ষকরা তো কোন একক সত্তা নন। প্রত্যেকের আলাদা দর্শন, আলাদা রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকবে তাই স্বাভাবিক।

কিন্তু যখনই তা পার্টিজান রূপ পায় মুশকিল হয় তখনই। তার চেয়েও বড় যা তা হলো এ রকম দু’চার জন শিক্ষকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজের গায়ে দুর্নামের কালি লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এ দুর্নাম ছড়ানো উদ্দেশ্যমূলক নয়ত? আঠারো শ’ সাতান্ন ও উনিশ শ’ চার সালে ইংরেজ প্রবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন ফেলো অথবা সিনেট সদস্যরা, যাদের অনেকেই ছিলেন উচ্চ পদের সরকারী কর্মকর্তা।

পাকিস্তান আমলেও এ অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে উনিশ শ’ তিয়াত্তর সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশে শিক্ষকরা প্রথম স্বাধীনতা পেলেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক পূর্বসূত্রতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার মতো দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর অভাবে ওই অধ্যাদেশের মধ্যে কিছু ত্রুটি থেকে গিয়েছিল। সেই ছিদ্র দিয়েই হয়ত অশুভ অনেক কিছু ঢুকেছে বিভিন্ন সময়ে। আর এ অজুহাত তুলে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশ বাতিল করার অপচেষ্টাও কম হয়নি।

বছর কয়েক আগেই তো ‘আম্ব্রেলা এ্যাক্ট অব পাবলিক ইউনিভার্সিটি’ নামে অভিন্ন আইন প্রণয়নের জোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। ওই আইন প্রণয়ন হলে তিয়াত্তরের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ বাতিল হয়ে যেত। সে সময় অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি আমতা আমতা করে ওই এ্যাক্টের বিরোধিতা করেছিলেন এমনভাবে যাতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের মনের ভাবটি আসলে আম্বেলা এ্যাক্টের পক্ষে। যা পাস হলে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ চলে যেত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে।

অর্থাৎ আবার সেই ফেলো ও সিনেটরদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ার পথই খোঁজা হচ্ছিল। কার স্বার্থে? শিক্ষকদের, দেশের না অন্য কোন শক্তির উদ্দেশ্য পূরণের জন্য? স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মৌলিকত্ব হারিয়ে বিকাশ-রুদ্ধ হয়ে পড়বে। তাতে ক্ষতি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, গোটা দেশের। মুখ থুবড়ে পড়া পরনির্ভরশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো মেরুদ-ওয়ালা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল প্রায় চার দশক আগে। এতটা সময় পেরিয়ে এর অনেক পরিবর্তন হয়ত সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, পুরো অধ্যাদেশই বাতিল করতে হবে।

যে আদর্শ ও স্বপ্নের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীন হয়েছিল, যে মূলমন্ত্রের ওপর স্বাধীন দেশের-রাষ্ট্রের কাঠামোটি দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রের কর্ণধাররা খুব অল্প সময়ই তার ওপর আস্থা রাখতে পেরেছিলেন। রাষ্ট্র একটু একটু করে মূলনীতি থেকে সরেছে আর তার অনিবার্য অভিঘাত এসেছে সমাজের গায়ে।

একটি বিকারগ্রস্ত সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষক এবং ছাত্রদের কাছ থেকে স্বাভাবিকতা আশা করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির নামে যা চলে তার ভিত্তি যে কোন আদর্শিক লড়াই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই মেধা ও যোগ্যতা থাকার পরও একজন শিক্ষককে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। বরং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন যারা তাদের প্রতি আনুগত্য দ্রুত উপরে ওঠার সিঁড়িটি এগিয়ে দেয়। এতে দলীয় সমর্থনের পাল্লা ভারি হলেও অন্তঃসারশূন্য হয় শিক্ষার ভিত।

শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের পলিটিক্যাল গেম যে কোন জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। শিক্ষা সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। সমাজের বিকাশরুদ্ধ হলে শিক্ষার বিকাশও রুদ্ধ হয়। শিক্ষকদের অনেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে এতই তৎপর থাকেন যে ভুলে যান তাদের আসল কাজ শিক্ষা দান। স্বাধীনতার এত বছর পরও ভিসি নিয়োগ প্রশ্নে দলীয় সঙ্কীর্ণতা ডিঙাতে পারেনি প্রায় কোন সরকারই।

জাতীয় স্বার্থকে বড় করে দেখার রাজনৈতিক সংস্কৃতিই তৈরি হলো না আজও। কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এক লেখায় বলেছেন, ‘এই রকম একটা ল-ভ- নৈরাজ্যিক সমাজের মধ্যে এমন কোন সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থান কি আদৌ কল্পনা করা যায় যার মধ্য দিয়ে জাতির সমগ্র জনশক্তি শিক্ষিত ও দক্ষ হয়ে উঠবে, মানুষের সম্ভাবনার সৃষ্টিশক্তি বিকশিত হবে, মানসিক ও বৈষয়িক বিশাল কর্মযজ্ঞে সমগ্র জনসাধারণ অংশ নিতে পারবে, মানুষের মাথা ও হাত সচল হবে, সব মানুষের কাজ থাকবে, দেশের সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে এবং সেই অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা ও বিকাশের নতুন স্তর অর্জন করতে পারবে? বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটা কি আকাশকুসুম কল্পনা নয়?

তেমন একটা সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিবিহীনও বটে। বরং বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে তার প্রতিটি স্তরে যে অরাজকতা, লক্ষ্যহীনতা, আদর্শহীনতা, দুর্নীতি, অব্যবস্থা ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে, বাস্তবের দিক থেকে বিচার করলে বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তা পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণই।

... কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থাটা নষ্ট হয় কখন? যে সমাজ প্রচণ্ড প্রাণশক্তিতে ভরপুর, যার সৃজনশক্তি নানা পথে প্রবল বেগে প্রকাশ পায়, তার শিক্ষা ব্যবস্থা পঙ্গু এবং নষ্ট এটা কি ঘটতে পারে? কাজেই সমাজের দুর্গতির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা দায়ী এটা না বলে আমাদের দুর্গত ধ্বংসনামা, নির্যাতন ও শোষণমূলক বিকারগ্রস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা আজকের বাংলাদেশের এই অচল শিক্ষা ব্যবস্থাটা জন্ম দিয়েছে বলতে হবে।’

সূত্র: জনকন্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061831474304199