উচ্চ শিক্ষা যখন শরমের

বোরহানুল হক সম্রাট |

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ যখন দেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে ‘বোমা’র বিস্ফোরণ ঘটালেন তখন সেই মঞ্চে স্বয়ং স্বরাষ্টমন্ত্রী উপস্থিত। শ্রেণিকক্ষে তুমুল জনপ্রিয় ইংরেজির এই অধ্যাপক যখন বললেন, মাউশি অধিদপ্তরের ঝাড়ুদারের পদে যে হাজার হাজার (উনি লাখও বলেছেন) আবেদন পড়েছে তাতে বিপুল সংখ্যক অনার্স-মাস্টার্স পাসও রয়েছেন। তার আক্ষেপ, ‘‘আমরা ঝাড়ুদারের উচ্চ শিক্ষা চাই না। আমরা মানসম্মত শিক্ষা চাই। আমরা কী ঝাড়ুদারের শিক্ষক হবো।’’ 

অধ্যাপক নেহাল আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, কেনো এমন আক্ষেপ তার, সে কথায় আমরা পরে আসব। তার এমন মন্তব্যর ৩ দিন পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা দেখে (রিডিং) পড়তে পারেন না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, গত ৯ মে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে সেই কথাটিই উঠে এসেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থায়নে আর কেউ নয়, খোদ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) পরিচালিত এক গবেষণাতেই শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির এই ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়তে পারেন না বলে ওই প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়েছে উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে  প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ তথ্য আমি মানি না। এ গবেষণা সঠিক হয়নি।  দুর্গম চরাঞ্চলের স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও বাংলা রিডিং পড়তে পারেন।

তবে বাস্তবতা আরো নির্মম, দুর্গম চরাঞ্চল নয়, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির নিজ জেলা চাঁদপুর সদরের মহামায়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকেরই বাংলা রিডিং পড়তে না পারার বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন ও চাঁদপুর সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাঈদা আলম। 

শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জেলা শিক্ষা অফিসার জানান, তিনি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি ও নানা অনিয়ম দেখে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষক শোকজ করেছেন।  শোকজে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ৫ম শ্রেণির ৪৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৪ জন বাংলা রিডিং পড়তে পারেন, বাকিরা পারেন না। চতুর্থ শ্রেণির ৪৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮ জন ইংরেজি রিডিং পড়তে পারেন, বাকিরা পারেন না। তৃতীয় শ্রেণির ৬৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০ জন গণিতের গুণ বুঝতে পেরেছেন, বাকি ৪৩ জন পারেননি। 

সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের দায়িত্বে থাকা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রাবেয়া আক্তার আমাদের বার্তাকে বলেছেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনেছি। গত মঙ্গলবার-ই শোকজের জবাব দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের এই ধরনের ঘাটতি দূর করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।’ 

গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন প্রাথমিকেই যে দুর্বলতা মানতে রাজি নন, সেটা যে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে সেই কথাই কী বলতে চেয়েছেন  মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ। আমরা এমন বিশ্লেষণে যেতে রাজি নই। বরং আবারো অধ্যাপক নেহাল আহমেদের মুখের কথায় ফিরে আসি। তিনি বলছেন এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে জানিয়েছেন-উচ্চশিক্ষায় এই এত এত সংখ্যাটা বর্তমানে কতটা অন্ত:সারশূন্যতায় পতিত হয়েছে।

গত ৬ মে এক রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘‘মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে কিছু পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ হচ্ছে। সেই পরিচ্ছন্নতা কর্মী মানে ‘ঝাড়ুদার’। সেই ঝাড়ুদার পদে হাজার-হাজার, লাখ-লাখ আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে কত জন যে অনার্স-মাস্টার্স পাস ছেলে মেয়ে! আমরা কি ঝাড়ুদারের শিক্ষক হবো? এদের না আছে মান, এরা না পারে নিজের নামটি লিখতে, ইংরেজির কোনটা ক্যাপিটাল লেটার কোনটা স্মল লেটার সেটাও তাদেরকে শেখাতে হয়। আমরা এই মানের শিক্ষা চাই না, আমরা মানসম্মত শিক্ষা চাই’’। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সবশেষ পরিসংখ্যান বলছে,  বর্তমানে দেশে ৫৩টি (২০২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৫০টি) সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী ছিল ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭ জন। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে এ সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৬। পরিস্থিতি বোঝাতে মাউশির ডিজি বলেছেন, ‘‘রাজধানীর তিতুমীর কলেজে এক সময় ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী ছিল। এটা কোনো গৌরবের কথা নয়, এটা শরমের কথা।  তার মুল বক্তব্য –‘‘ উচ্চ শিক্ষা সবার জন্য না। এত উচ্চ শিক্ষিত কী ঝাড়ুদারের জন্য তৈরি করবো।’’ 

হয়তো ওপরের এই লাখ লাখ সংখ্যার দিকেই দৃষ্টিপাত করেছেন অধ্যাপক নেহাল। তার এই আক্ষেপ একজন অধ্যক্ষের, একজন শিক্ষাবিদের। আমরা আশা করি, এই লাখ লাখ সংখ্যার ভিড়ে তারা সংখ্যায় কম যারা ইংরেজির ক্যাপিটাল আর স্মল লেটার আলাদা করতে ব্যর্থ হবেন। 

প্রাথমিকের পরিসংখ্যান আরো দীর্ঘ, বাস্তবতা আরো করুণ, অধ্যাপক নেহালের ভাষায় শরমের। রাজনীতির আবেগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী যাকে দূরে ঠেলে রাখতে চান।   

সরকারি ও বেসরকারি উচ্চশিক্ষার দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অবশ্য এই নিয়তির সাথে পরিচিত অনেকদিন ধরেই। ইউজিসির সুপারিশ ‘উচ্চশিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতিতে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক মাস্টার প্লান করা অতীব জরুরি।’ এরপরই কমিশনের পৃথক সুপারিশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে প্রায়শই স্বজনপ্রীতি ‍ও দুর্নীতির অভিযোগ ও তাতে উচ্চশিক্ষার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।  ২০২১ এর ইউজিসির সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করা হয়েছে।   

গত ১০ বছরে যাদের হাত ধরে সবচেয়ে বেশি অনার্স কলেজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পরিষদবর্গ অধ্যাপক নেহালের ঝাড়ুদারের উচ্চশিক্ষা বিষয়ক বক্তব্যর সময় ওই অনুষ্ঠানেই উপস্থিত ছিলেন। সব নিয়ম-কানুন-বিধি-বিধান ও বাস্তবতা উপেক্ষা করে শিক্ষার মানের বিসর্জন দিয়ে যারা এসব শিক্ষালয়ের জন্ম দিয়েছেন তারা কী সেদিন লজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন।

লেখক : বোরহানুল হক সম্রাট, প্ল্যানিং এডিটর 

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আপিলে যাবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিকে বৃহস্পতিবারও ছুটি - dainik shiksha আপিলে যাবে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিকে বৃহস্পতিবারও ছুটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ মে’র পরীক্ষা স্থগিত শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় - dainik shiksha হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে - dainik shiksha সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড - dainik shiksha মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নির্মিত তাঁবু গুটাতে কলাম্বিয়া শিক্ষার্থীদের অস্বীকৃতি - dainik shiksha ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নির্মিত তাঁবু গুটাতে কলাম্বিয়া শিক্ষার্থীদের অস্বীকৃতি শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ - dainik shiksha শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার পুলিশ সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি - dainik shiksha সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026419162750244