প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় ৮১ জন চাকরিপ্রার্থীকে ৩৫তম বিসিএসে চূড়ান্ত নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তবে তাঁদের মধ্যে ১৫ জনের অভিভাবকের মুক্তিযোদ্ধা সনদে ঘাপলা থাকায় নিয়োগ দেয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বঞ্চিত প্রার্থীরা উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ৩ এপ্রিল ৩৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত নিয়োগের গেজেট প্রকাশ করে। নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আগামী ২ মে যোগদান করতে বলা হয়েছে। পদায়ন শেষে এসব নবীন কর্মকর্তাকে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ আগস্ট সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) দুই হাজার ১৫৮ জনকে মনোনীত করার পর পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ওই প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান শুরু করে। ছয় মাস অনুসন্ধানের পর এসবি কয়েক দফায় প্রতিবেদন দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এসবির সঙ্গে যৌথভাবে অনুসন্ধান করেছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৮১ জন বঞ্চিত হয়েছেন নিয়োগ থেকে। এসবি ও প্রশাসন মূলত চাকরিপ্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখার কথা। তবে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করা ছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের পরিবারের কোনো সদস্য জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্য কোনো স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না তাও খতিয়ে দেখেছেন গোয়েন্দারা। একই সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত রাজনৈতিক কারণেই ৮১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও অভিভাবকের মুক্তিযোদ্ধা সনদে ঘাপলা পাওয়ায় ১৫ জনকে নিয়োগ দেয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
গত বছরের ১৭ আগস্ট ৩৫তম বিসিএসে দুই হাজার ১৫৮ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করে পিএসসি। সাংবিধানিক এ সংস্থাটি দ্বিতীয় দফায় আরো ১৬ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার ১৭৪। তাঁদের মধ্যে দুই হাজার ৭৩ জনের নামে গত ২ এপ্রিল নিয়োগপত্র ইস্যু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর ১১ দিন পর গত বৃহস্পতিবার আরো ২০ জনের নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট দুই হাজার ৯৩ জনের নিয়োগপত্র ইস্যু করা হলো। বাকি ৮১ জন প্রার্থী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চূড়ান্ত নিয়োগ লাভে বঞ্চিত হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিএসসির সুপারিশ সত্ত্বেও চূড়ান্ত নিয়োগ লাভে বঞ্চিত হয়েছেন বরিশাল জেলার এক নারী প্রার্থী। তাঁর বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। নেত্রকোনা জেলার এক প্রার্থী স্বাস্থ্য ক্যাডারে উর্ত্তীণ হয়েও চূড়ান্ত নিয়োগ পাননি। নীলফামারী জেলার এক প্রার্থীর শিক্ষা ক্যাডারে চাকরি হয়নি তাঁর পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে। চূড়ান্ত নিয়োগের গেজেট জারি হওয়ার পর যাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঘুরছেন। আদালতে যাওয়া ছাড়াই তাঁরা এর একটি সুষ্ঠু সমাধান চান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দিচ্ছেন না বলে ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, পরিস্থিতি যা তাতে বিষয়টি নিয়ে তাঁরা আদালতেই যাবেন।
৩৫তম বিসিএস নানা কারণে আলোচিত ছিল। বিধিমালা পরিবর্তন করে ৩৫তম বিসিএস থেকেই প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ এবং সময় এক ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে দুই ঘণ্টা করা হয়। সরকারি চাকরি পেতে ৩৫তম বিসিএসে দুই লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ প্রার্থী আবেদন করেন। বিসিএসের ইতিহাসে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। এর আগে ৩৪তম বিসিএসে দুই লাখ ২১ হাজার ৫৭৫ জন আবেদন করেছিলেন। এই হিসাবে গত বিসিএস থেকে এবার প্রার্থীর সংখ্যা ২২ হাজার ৫৩২ জন, অর্থাৎ ৯ শতাংশ বেশি।
২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পিএসসি।
অন্যান্য বিসিএসে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা পিএসসির সুপারিশকৃত প্রার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই করলেও এবার একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রার্থীদের তথ্য যাচাই করেছে। পাশপাশি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনও প্রার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে। এক প্রার্থী সম্পর্কে দুই গোয়েন্দা সংস্থা দুই ধরনের তথ্য দেওয়ার কারণে অতীতে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের জটিলতা কাটাতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছে। এ কারণে ৩৫তম বিসিএসের আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের। আর জেলা প্রশাসনও তথ্য যাচাই করবে বলে ঠিক করা হয়। সে অনুযায়ী ৩৫তম বিসিএসের প্রার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে এসবি এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন।
একই প্রার্থী সম্পর্কে দুই গোয়েন্দা সংস্থা ভিন্ন ধরনের তথ্য উপস্থাপন করায় ২৮তম বিসিএস থেকে ৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত ১৪০ জন প্রার্থীর নিয়োগ আটকে ছিল। তাঁদের মধ্যে ৩৪তম বিসিএসেরই ৬৪ জন। শেষ পর্যন্ত এসব প্রার্থীর তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসকের (ডিসি) তদারকিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেওয়ার পর গত ডিসেম্বরে ১৪০ জনকে নিয়োগ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর বাইরে আরো ৭০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো ঝুলে আছে নানা কারণে।