দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনা নিয়ে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগে ভুগছে। এ ছাড়া কোনো রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না অন্তত ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠার প্রবণতাও আছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট বা বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যাসহ নানা কারণে অনেক শিক্ষার্থী করোনাকালীন দূরশিক্ষণে অংশ নিতে পারছে না বলেও জানা গেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে ব্র্যাক আট বিভাগের ১৬টি জেলায় মে মাসের ৪ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালনা করে। এতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকপড়ূয়া এক হাজার ৯৩৮ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এ ছাড়া সংশ্নিষ্ট অংশীদারদের মধ্য থেকে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিস্তারিত সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে।
গতকাল শনিবার ডিজিটাল সম্মেলনে এই জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। এ ছাড়া প্যানেল আলোচক হিসেবে যোগ দেন একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম ও অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) রতন চন্দ্র পণ্ডিত, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক তপন কুমার ঘোষ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ, এটুআই প্রকল্পের উপদেষ্টা অনীর চৌধুরী, ইউনেস্কোর শিক্ষা বিভাগের প্রধান সুন লি, ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিক্ষা বিভাগের প্রধান নূর শিরিন মো. মোক্তার, যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ডিএফআইডি) মানব উন্নয়নবিষয়ক টিম লিডার ফাহমিদা শবনম, যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা বিভাগের (ইউএসএইড) আলী মো. শহিদুজ্জামান এবং ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। জুলাই থেকে শিক্ষকদের জন্য অঙ্ক বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হতে যাচ্ছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের বিষয়ে শিক্ষকের সামর্থ্য আরও বাড়াতে হবে, যাতে তারা এ পদ্ধতিতে শিক্ষাদানে স্বচ্ছন্দবোধ করে। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ-আতঙ্কে ভুগছে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা (২৯%)। নারী শিক্ষার্থী, মাধ্যমিকপড়ুয়া, পলিল্গ অঞ্চলের বাসিন্দা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৭ শতাংশ উদ্বেগ ও আতঙ্কে ভুগছে। আতঙ্কে ভুগলে কী করে- এ প্রশ্নের উত্তরে তারা জানিয়েছে, একেবারেই নীরব হয়ে যায়, মেজাজ খারাপ করে, পড়াশোনা বা খেলাধুলা কোনোটাই করে না, বাইরের কাউকে দেখলে আতঙ্ক বোধ করে, একা থাকতে ভয় লাগে ইত্যাদি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালীন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে (৮২%) নিপীড়নের ধরন মানসিক। তবে শারীরিক ও যৌন নিপীড়ন, ঘরে বন্ধ করে রাখা বা জোর করে কাজ করানোর মতো ঘটনাও জানিয়েছে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা। এ ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা অন্যদের চেয়ে বেশি (১৬%)। এ ছাড়া ২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বলেছে। নারী শিক্ষার্থীর যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা আরও বেশি হতে পারে বলে জরিপ প্রতিবেদনে মতপ্রকাশ করা হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে তথ্য দিতে হয়তো সংকোচ বোধ করেছে।
শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ (৫৪%) স্কুল খোলার পর বাড়তি ক্লাস করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে, তা জানা থাকলেও ৪৯ শতাংশ কম সময়ের মধ্যে স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে। এ ছাড়া পাঠ্যসূচি বা সিলেবাস ছোট করা এবং পরীক্ষায় কড়াকড়ি শিথিল করার পক্ষেও অনেকে মত দিয়েছে। করোনাকালীন মানসিক চাপ বা ক্ষতি নিরাময়ের জন্য উত্তরদাতা শিক্ষার্থীরা যেসব পন্থার কথা বলেছে, তার মধ্যে স্কুল খোলার পর বিনোদনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, উপহার প্রদান, উপবৃত্তির অর্থ বাড়ানো এবং দূরশিক্ষণ ও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও জোরদারে পদক্ষেপ গ্রহণ উলেল্গখযোগ্য। দূরশিক্ষণে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্রুত এ কার্যক্রমকে শক্তিশালী করে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে জরিপ প্রতিবেদনে মতপ্রকাশ করা হয়।