প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় উপবৃত্তির অর্থ অগুণতি মানুষকে শিক্ষার আলোয় এনেছে, আনছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষায় কোটি শিক্ষার্থী সরাসরি সরকারের উপবৃত্তির অর্থ পেয়েছেন, পাচ্ছেন। এর ফলে পরিবার না পারলেও বা না চাইলেও শিক্ষার্থীরা স্কুল আর কলেজের আঙিনায় পা রাখতে পারছেন।
এই উপবৃত্তি নিয়ে হালে অনেক রকম খবর শোনা যাচ্ছে। এগুলোর ভেতর সবচেয়ে শঙ্কার খবর সম্ভবত, গত ১০ বছরের মধ্যে উপবৃত্তি প্রাপ্তির সংখ্যা এখন সর্বনিন্ম পর্যায়ে নেমেছে। মাধ্যমিকে ৪৮ লাখ থেকে ৪০ লাখ, উচ্চ মাধ্যমিকে ৮৭ লাখ নেমে ৪৭ লাখ হয়েছে। এমনকি ২০১৭-১৮ শিক্ষাবছরে উচ্চশিক্ষায় অর্থাৎ স্নাতক পর্যায়ে ২ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষার্থী উপবৃত্তির আওতায় এলেও গত বছর তা ১ লাখ ৪০ হাজারে ঠেকেছে। অনলাইনে এসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পাতাতেই।
আমরা সরকারের এই নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ ও তথ্য প্রদর্শনের মানসিকতাকে স্বাগত জানাই। সেই সাথে আমরা কিছু পর্যবেক্ষণ রাখতে চাই, যাতে যে উদ্দেশ্যে এর যাত্রা শুরু তার ফসল যেনো সত্যিকার অর্থেই ঘরে ওঠে।
এটা ঠিক যে উপবৃত্তি নিয়ে সারাদেশেই কিছু অর্থলোভী শিক্ষক-কর্মকর্তা ও গভর্নিং বডির সদস্যের অনাচারের নানা কাহিনী জনমনে প্রায় প্রতিষ্ঠিত। তবুও মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো সিদ্ধান্তকে কেউই স্বাগত জানাতে পারেন না।
বাংলাদেশের সব সরকারের আমলেই উপবৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনার প্রক্রিয়া প্রশংসনীয়ভাবে চলেছে। প্রথমে শুধু ছাত্রীরা এর আওতায় থাকলেও বর্তমানে ছাত্ররাও এর অন্তর্ভুক্ত। আশির দশকে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার একটি স্কুলে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ছাত্রীদের আর্থিক সহায়তার যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এখন বিশালাকার ধারণ করেছে। বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন ৪টি উপবৃত্তি প্রকল্পে - সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ), সেকোন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ), মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রজেক্ট (এসইএসপি) ও উচ্চ মাধ্যমিক উপবৃত্তি (এইচএসএসপি) কে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট হারে ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ‘সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচি”র ধারা চলছে, যা প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
যে পাঁচটি উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে এই উপবৃত্তি তার প্রথমটি হলো- বিদ্যালয় বা কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির হার বৃদ্ধি। ঠিক এই জায়গাটি নিয়েই আমাদের কিছু উদ্বেগ রয়েছে। বর্তমানে বছরভিত্তিক ৩৫ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী এই উপবৃত্তির আওতায় আছেন। সম্প্রতি ৬ষ্ঠ থেকে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ৪৫ এর নীচে নম্বর পেলে এবং ক্লাসে উপস্থিতির হার ৭৫ শতাংশের নিচে নেমে গেলে তাদের উপবৃক্তির স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে নিষ্ক্রিয়করণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ উপবৃত্তি প্রাপ্ত সবাইকে একশ দিনের মধ্যে কমপক্ষে ৭৫ দিন স্কুলে উপস্থিতি থাকতেই হবে। তা না হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের মাধ্যমে উপবৃত্তি বাতিল নিশ্চিতকরণের বিষয়টি তদারকি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
যদিও উপবৃত্তি নিয়ে অনেক ধরনের অনিয়ম ও অনাচারের গল্প সাম্প্রতিক অতীতেও প্রকাশিত হয়েছে। কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ, কখনো শিক্ষা কর্মকর্তার সহায়তায় প্রতারকচক্র শিক্ষার্থীদের টাকা তুলে নিয়েছেন এমন খবর হয়েছে। শিক্ষার্থীর কিস্তির টাকা তুলে দিতে কমিশনও পকেটে ভরেছেন অনেকে। উপবৃত্তির নামে শিক্ষার্থীর নম্বরে মেসেজ দিয়ে প্রতারণা চলেছে অনেক। অভিযোগ, ছোটদের উপবৃত্তি নিয়ে কোটি কোটি টাকার ডিজিটাল ডাকাতি করে এদেশের মানুষ। কিন্তু তারপরও আমরা এই উপবৃত্তির ধারণাকে সমর্থন করতে চাই। তাই নম্বর বা উপস্থিতির মতো জটিলতায় ফেলে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে অনুৎসাহিত বা বিতাড়িত করা নিশ্চয়ই সমীচীন নয়।
গরীব যে মেয়েটিকে তার মায়ের সাথে সংসারের কাজ করতে হয়, গরীব যে ছেলেটিকে সংসারের উপার্জনের দায় নিতে হয়, তারা সব সময় কীভাবে শ্রেণিকক্ষে হাজির হতে পারবেন? যেভাবে ক্রমাগতভাবে উপবৃত্তির আওতায় আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে তাতে শতকরা ৭৫ ভাগ উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা যোগ হলে তার ফল কী হবে তা বড় ভাবনার বিষয়। অথচ আদেশ এসেছে একশ দিনে ৭৪ দিন উপস্থিত থাকলেও কেউ আর উপবৃত্তি পাবেন না।
আমরা জানি, বাল্যবিয়ে কীভাবে আমাদের গরীব মেয়েদের স্কুলে আসতে বাধা দিয়ে চলেছে। এর আগেই আমরা তুলে ধরেছি এক নির্মম বাস্তবতা। যেখানে দেখা যায়, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের করোনা মহামারির মধ্যে দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছেন প্রায় ৭৮ হাজার ছাত্র। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক প্রতিবেদনে সেই তথ্য উঠে এসেছিল।
শুধু তাই নয়, এটাই বাস্তবতা যে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাল্যবিয়ের হারে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি–২০২৩ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে ২০০৬ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে।
ঠিক এখানেই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতো উপবৃত্তি। মেয়েরা বিয়ের আগে এই উপবৃত্তি নিয়ে টিকে থাকতেন নিজের লেখাপড়ায়। আর ছাত্ররা শিশুশ্রমের বদলে যেতেন বিদ্যালয়ে। কিন্তু এখন উপস্থিতির হার আর ৪৫ শতাংশ নম্বর প্রাপ্তির বাধ্যবাধকতায় তাদের শিক্ষা জীবন থেকেই ছিটকে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট্রের সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের উপবৃত্তি জুন ২০২৩ থেকে বাড়িয়ে আরো ৩ বছর অর্থাৎ ২০২৬ এর জুন করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ওই সভায় শিক্ষার্থীদের আবেদন প্রহণ, নির্বাচন ও অর্থ বিতরণ প্রক্রিয়ায় লোকবল নিয়ে সংকটের কথা উঠে আসে। উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বিতরণের স্কুল ব্যাংকিং ও উপবৃত্তির স্কিম ডকুমেন্টের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে গভর্নিং বডির সদস্যের বদলে প্রতিষ্ঠানের আইসিটি শিক্ষককে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। এছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে তথ্য এন্ট্রি না করার জন্য সতর্ক করা হয়। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এই নির্দেশনা কতোটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তার নজরদারি প্রয়োজন।
এবার আসি উচ্চ শিক্ষায় সরকারের সহায়তা প্রসঙ্গে। বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বাইরেও উচ্চ শিক্ষায় এই সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন এ খবর খুব একটা জানে না মানুষ। শুধু তাই নয়, অর্থের অভাবে যাতে উচ্চশিক্ষা থেকে কেউ বঞ্চিত না হন তার দুটি প্রচেষ্টার কথা আমরা তুলে ধরতে পারি। যেমন প্রজাতন্ত্রের বেসামরিক কর্মে নিয়োজিত সব সরকারি-আধাসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত দপ্তর ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ‘জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫’ অনুযায়ী ১৩ থেকে ২০তম গ্রেডের সব কর্মচারীর সন্তান উপবৃত্তি প্রাপ্তির যোগ্য বিবেচিত হবেন; এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী, এতিম শিক্ষার্থী, তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থী, ভূমিহীন পরিবারের সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/সন্তানের সন্তান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুস্থ পরিবারের সন্তান উপবৃত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।
প্রথম বর্ষ থেকে ৫ম বর্ষে শিক্ষার্থী প্রতি উপবৃত্তি, বইক্রয় ও পরীক্ষার ফি বাবদ ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ। কিন্তু এখানেও পরিসংখ্যান অন্য কথা বলছে। দেখা যায়, ২০১৭-১৮ বছরে স্নাতকে ১ লাখ ৯০ হাজার ছাত্রী ও ৬৯ হাজার ৮২৭ জন ছাত্র এই উপবৃত্তি ও টিউশন ফির সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু ২০২১-২২ শিক্ষাবছরে এই সংখ্যা ৮১ হাজার ছাত্রী ও ৫৮ হাজার ছাত্রে নেমে আসে। ফলে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবছরে উচ্চ শিক্ষায় ১৩৭ কোটি টাকার ব্যয় ২০২১-২২ এ ৭৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের পর উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বাবদ বিতরণকৃত টাকার পরিমাণ এখন তাই সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
২০১২-১৩ অর্থবছরে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ে শুধু নারী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান কার্যক্রম শুরু করা হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ছাত্রীদের পাশাপাশি ছাত্রদেরকেও উপবৃত্তি কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে সব উপবৃত্তি প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টে স্থানান্তরিত হবে মর্মে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।
উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি, ঝরে পড়ার হার রোধ, নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিসহ শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যাসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে ট্রাস্ট সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাইছে। কিন্তু পরিসংখ্যানগুলো আমাদের সেই নিরাপত্তা বেষ্টনী নিয়ে ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। এই বেষ্টনী বা বেড়ার দায়িত্বে যারা তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কথা উঠেছে সরকার যতোটা আন্তরিকতা নিয়ে এই বেষ্টনী তৈরি করতে চাইছে সেই বেড়া নিজেই খেত খেয়ে ফেলছে কী? তা না হলে পড়ার টাকা দিয়েও শিক্ষার্থীদের স্কুল বা কলেজমুখী করা যাচ্ছে না কেনো?
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুবই জরুরি। আরো জরুরি যেকোনো মূল্যে শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা। নিরক্ষতা ঠেকাতে আমরা মনে করি সবাইকেই সেই জায়গাতে দাঁড়ানো উচিত। নানা নিয়মের বেড়াজালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একটা বদ্ধ ঘর হিসেবে নির্মাণ না করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বহুল পঠিত ‘ভালোবাসা নাও হারিয়ে যেও না’ বইটির আদলে সবার একসুরে বলা উচিত- ‘উপবৃত্তি নাও তবুও হারিয়ে যেও না।’ একইসঙ্গে উপবৃত্তিকে আরো ফলপ্রসু কি করে করা যায় সে বিষয়েও আরো ভাবনা-চিন্তা প্রয়োজন।
লেখক : বোরহানুল হক সম্রাট, প্ল্যানিং এডিটর, দৈনিক আমাদের বার্তা