উপসংহার বলে কিছু নাই

হাসান আজিজুল হক |

উনিশশ' বায়ান্ন সালের পর থেকে আমাদের সকল আন্দোলন, সমস্ত কিছুর সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা জড়িত হয়ে গেছে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে কোনো আন্দোলনই একটা সময় মরে যায়; তার আবেদন বা প্রাসঙ্গিকতা আর থাকে না। এ প্রসঙ্গে বলা যায় ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলুশনের কথা। ইতিহাসের এত বড় প্রভাবশালী ঘটনা, অথচ এখন হয়তো সেই দিনটি পালিত হয় কি হয় না তার ঠিক নেই।

জাতি হিসেবে আমরা বড় বাক্যবাগীশ। সমাজ যে বদলাচ্ছে; সেই বদলের সঙ্গে আমাদের একুশের আন্দোলন-চেতনার সমন্বয় করাটা জরুরি, এই পরিবর্তনটা যে দরকার- তা এখন কেউ ভাবে না। কারণ, ভাবলে অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের দেশটা গরিব, দেশের মানুষের বিশাল অংশ প্রায় নিরক্ষর, তাদের মনেও তেমন কিছু নেই; কিছু মধ্যবিত্ত যুবক আছে, কয়েকটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল আছে আর আছে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের কমিটি, তাদের দিয়েই প্রতি বছর নানা আয়োজন হয়ে থাকে।

যদি বলি, শ্বাসে এবং মূলে আমাদের সমাজের ভিতরে একুশ কি ঢুকেছে? উত্তর 'না'-ই আসবে। তা যদি ঢুকতো তবে ষাট, বাষট্টি পার হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে দুর্ধর্ষ আন্দোলন-সংগ্রামটা দেখা গেল- সেটা আজকে এই অবস্থায় এসে পৌঁছাতে পারতো না। এই যে জায়গাটায় এখন আমরা পৌঁছেছি- এর কারণ কী? আমি বললাম, জানি না। এমনভাবে সবাই বলবে, আমি জানি না, আমি জানি না। এর জন্য কেউ না কেউ তো দায়ী বটেই! কিন্তু দায়ীটা হবে কে? 

একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে মাতামাতি করার আগে এ কথাগুলো তো কাউকে না কাউকে স্পষ্ট করে বলতে হবে। সেই সাতচল্লিশের পর থেকে এখন পর্যন্ত, জনসাধারণ যেখানে ছিলো সেখানেই থেকে গেল। আর আমরা আশা করতে থাকলাম, জনসাধারণ একুশের চেতনায় জাগ্রত আছে- তাই কি হয়! আপনি গ্রামের মধ্যে নানা রকমের এটা-ওটা ব্যবসা, এনজিও ঢুকিয়ে দেবেন; তাহলে সেই গ্রামটা কি আর কোনোদিন প্রকৃতির সেই শুদ্ধ সাঁওতাল গ্রাম থাকবে, থাকবে না। 

প্রত্যেক বছরেই একবার আমাদের একুশের চেতনা, আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের গৌরব বলে ঢাক- ঢোল পেটানো হয়; এই 'আমাদের' বলতে আসলে কাদের বোঝানো হয়? 'আমাদের'টা আসলে কারা? 'আমাদের' শব্দটা অত্যন্ত অস্পষ্ট একটা শব্দ। এই শব্দটি দিয়ে আসলে বহুকিছু এড়িয়ে যাওয়া যায় আর কি। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, আমরা বিপরীত মেরুতে চলে এসেছি। একুশের চেতনার ঠিক উল্টো জায়গায় এসে পৌঁছেছি।

আমরা টেবিলের এপারে ছিলাম, টেবিলের ওপারে গিয়েছি- এর বেশি কিছু আসলে হয়নি। এর পর হয়তো এসবও হবে না। কিংবা গ্রামদেশে এখনই এসবের কিছুই নাই। কেন থাকবে! থাকার কোনো কারণও নাই। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা মানুষের মধ্যে কাজ যে করবে, সেটা কীভাবে? আজকে ছয় দশক পর কাজ করলে, তবেই না আগামীতে করবে। তা না হলে মানুষ পিছু হটবে কীভাবে? মানুষ আসলে কেমন করে পিছু হটে? এ সবকিছু নিয়ে একটা গোলমেলে সাংস্কৃতিক অবস্থা বিরাজ করছে।

এর সাথে অর্থনীতির কোনো সাযুজ্য নেই, শিক্ষার কোনো মিল নেই। এসবের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করার প্রথম দায়িত্ব আমরা যারা রাষ্ট্র চালাই তাদের। তাই বাস্তবতার এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গ্লানি বা হতাশা ছাড়া আর কিছু নাই। আমি কোনো আশার আলো দেখছি না। কারণ, এখানে যা কাজ আছে, যা কাজ হচ্ছে, তাতে চেতনা সংক্রান্ত কোনো রকম পরিকল্পনা নেই। চেতনা আছে শুধু কিছু বুলি আওড়ানো আর টকশোর আস্ম্ফালনে। তবু, কিচ্ছু হবে না- এ কথা আমার নয়। একটা দেশের সংস্কৃতিকে উন্নত করতে না চাইলে এবং চাইলে- দু'ক্ষেত্রেই প্রথম কাজ হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার অবস্থা ভালো আছে কি মন্দ আছে- এ প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই পড়ে আছে।

আমাদের উচ্চশিক্ষার বাস্তব কার্যকারিতাও সবার কাছে অনিশ্চিত। একটা মানুষ এত পড়াশোনা করে কী করবে, আদৌ কী করার আছে এ ব্যাপারে, শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারে না। কেউ যদি আমাকে বলে যে, এত হতাশ হচ্ছেন কেন? আমি বলবো, আরে বাবা, হতাশই বা হবো না কেন! বলা হয়েছিলো, দেশের মানুষের শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দেবে, খাজনাহীন জমি করে দেবে। কিন্তু খাজনাহীন জমি তো দূরে থাক, খাস জমিগুলো- সেগুলো যেভাবে ছিলো সেভাবেই পড়ে রইলো ৫০ বছর ধরে।

কী হবে আমাদের এখানে ভাষা চেতনা, কী হবে আমাদের এখানে আদিবাসীদের সমস্যা? এসবের কিছুই ঠিক করা হয়নি এখনও। আর করলে যে ঢাকার নিজেরই চলবে না। তার মানে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, : the hole country has become the country of few. তবু বলি যে, বাংলাদেশে অন্ততপক্ষে ৩৪ কোটি হাত তো আছে। তাকে যদি প্রকৃত অর্থে কাজে লাগানো হয়, তাহলে আমাদের জন্য অসম্ভব তো কিছুই নয়। কিন্তু সেই সম্ভবটাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে যে সংস্কারগুলো দরকার, সেগুলো তো করতে হবে। এমনকি কোনোদিন ঘটবেই না যে, এই হাতগুলো যখন যা করা দরকার তা করে ফেলবে, যে করছে না তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে! নিশ্চয়ই করবে।

ভাষা আন্দোলনকে ঘিরেই তো এত সব কথা। যে আন্দোলনটা করেছেই তরুণরা। তরুণরা সব সময়ই এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে আসে। এর মাঝখানে সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তায় নেমে আসা, এসব যদি না দেখতাম তাহলে হয়তো ভাবতাম, আমাদের তরুণরা চিরকালের জন্যই ডুবে গেছে। 

আশা কিংবা উপসংহারে বাংলাদেশের ব্যাপারে যদি কিছু বলতে হয়, তবে বলবো- সংহার যখন একবার হয়েই গেছে তার আবার উপায় কী? আমাদের উপসংহার বলে কিছু নাই। ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজন, তাই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। অন্তত আমাদের প্রাণের জন্য, মন খুলে নিজ নিজ ভাষায় কথা বলার জন্য। 

লেখক,কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক 

সূত্র: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022449493408203