উপাচার্যগণের অত্যাশ্চর্য সমাচার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাত সাড়ে ৯টা। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েই কার্যালয়ের তালা ভেঙে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না। দায়িত্ব হস্তান্তর করার সুযোগ দেওয়া হলো না। সহকর্মীদের স্বাগত জানানোর প্রথা উপেক্ষিত হলো। কিন্তু উপাচার্য ক্ষমতাসীন হয়ে গেলেন। চেয়ারে বসার এই যে এত সাধনা, সবটাই কি সম্মানের জন্য? রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উপাচার্যের পদ কতটা সম্মানের, তা নিয়ে দ্বিধা থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বিশাল সম্মানীয় মানুষ। এই সম্মান উপাচার্য পদের জন্য নয়। এ সম্মান একজন শিক্ষক হিসেবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকরা অবমূল্যায়িত হওয়ার পাশাপাশি সমাজেও তার প্রভাব দেখা যায়। আর এতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন এমন উপাচার্যরা। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সময়ে এমন উপাচার্যদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রক্রিয়ার ভিন্নতা থাকলেও মানসিকতা একই। প্রতিদিনের জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে নানা ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। ঘটনা যা-ই হোক, তা আংশিক সত্য হলেও পরিবেশ ভয়াবহ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই ভয়াবহ পরিবেশ থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ জরুরি। শঙ্কার বিষয় একটাই, এ পরিবেশ থেকে দেশ ও জাতি কি রক্ষা পাবে? শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, বেশ কিছু বছর থেকে সাধারণ মানুষ উপাচার্য পদ পাওয়ার কঠিন প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করছে। সরকারি দলের মতাদর্শের ব্যক্তি কঠিন লবিংয়ের মাধ্যমে এ পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন। এ প্রতিযোগিতা শুধু সম্মানের জন্য; সে অবস্থা এখন আর নেই। শুধু সম্মানের জন্য হলে কেউ মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন না। আর আমাদের উপাচার্যদের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু বিপরীত। তারা একান্ত বাধ্য না হলে পদত্যাগ করতে চান না। তা সে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যত আন্দোলন-সংগ্রামই করুন বা সাংবাদিকরা জাতীয় দৈনিকে যতই অনিয়ম প্রকাশ করুন না কেন। সাধারণ মানুষের ভাবনার মধ্যে আসে না- উপাচার্য পদে কী মধু আছে? কোন মধুর কারণে উপাচার্যরা অনেকেই কানে তুলো আর পিঠে কুলো বেঁধে বসে থাকেন। শুধু উপাচার্য পদ নয়; কলেজের অধ্যক্ষ থেকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ পেতে আগ্রহীদের দৌড়ঝাঁপের অন্ত নেই। স্কুল-কলেজে বাণিজ্যের কথা কমবেশি শোনা যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য আছে কি-না, জানি না। সম্প্রতি যে ঘটনাগুলো প্রকাশ পেয়েছে তাতে উপাচার্য পদে বাণিজ্য না থাকাটাই আশ্চর্যের বিষয়।

এখন কমে গেলেও একসময় যে কোনো পরীক্ষায় ভালো ফল করলে মেধাবী সন্তানদের ছবিসহ সাফল্যের বিবরণ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো। এটা পত্রিকার পক্ষ থেকেও হতো, আবার অনেক অভিভাবকও বিজ্ঞাপন আকারে সন্তানের সাফল্য প্রচার করতেন। এই মেধাবীরা চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রশাসক, কাস্টমস ইত্যাদির মতো লাভজনক পেশা গ্রহণ করে মানুষের সেবা করার আগ্রহ প্রকাশ করত; এখনও তা-ই করে থাকে। হাজারে একজন বা লাখে একজন শিক্ষক হতে চাইলেও তা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাত্র। আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি- কেউ স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করতে চায়। তাই এ কথা বলাই যায়, আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের একটা বড় অংশই আগ্রহ নিয়ে এখন আর এ পেশা গ্রহণ করে না। সে ক্ষেত্রে অনাগ্রহ নিয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণকারী, তার প্রশাসক হওয়ার সুপ্ত বাসনা পূরণের জন্য উপাচার্য-অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক পদের দৌড়ে নাম লেখান- এ ভাবনা মনে আসাটাই স্বাভাবিক। দক্ষতা-যোগ্যতাকে পিছে রেখে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে করণীয় নির্ধারণ করতে তাদের কেউ ভুল করতে রাজি নন। পদ পেতে আগ্রহী এসব শিক্ষক প্রয়োজনীয় সব পথে হেঁটেই নির্দিষ্ট আসনে পৌঁছে যান।

বেশ কয়েক দিন ধরে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু সংবাদ জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তুঘলকি কাণ্ডের কিছু নমুনা সাধারণ মানুষের সামনে এসেছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রমাণ হয়, দেশে কোনো কাজের জন্যই কারও নূ্যনতম জবাবদিহি করতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে বই কেনার দায়িত্ব দিয়েছে। বই সরবরাহের জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা অগ্রিম দিয়ে আজ পর্যন্ত একটা বইও পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়। একজন শিক্ষক ছয় মাসের মধ্যে পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। বিশেষ কোনো যোগ্যতায় একজন মানুষ পদোন্নতি পেতেই পারেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ওই বিভাগে একজন মাত্র ছাত্র; যেটা তিনি নিজে। যে শিক্ষার্থী, তিনিই শিক্ষক। এমন শিক্ষার সুযোগ বোধ করি বিশ্বে বিরল। যদি নূ্যনতম জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এমন শিক্ষার সুযোগ কি সম্ভব? অনেকের কাছে বিষয়গুলো খুব সাধারণ মনে হতে পারে; কিন্তু সত্যি কি তাই? যদিও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে উপাচার্য রাতের অন্ধকারে পুলিশ পাহারায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে, পুরো বিষয়ের জন্য তাকে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। তিনি আবার পুরোনো কর্মস্থলে স্বপদে বহাল থেকে কাজ শুরু করবেন বা আরও কোনো উঁচু পদে দায়িত্ব পেয়ে যাবেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও এসেছে, অপর একজন উপাচার্য ছাত্রনেতাদের একটি বিশাল অঙ্কের 'ঈদ বোনাস' দিয়েছেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের কমিশন বাবদ ছাত্রনেতাদের বিশাল অঙ্কের অর্থও দিয়েছেন। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ যদি তিনি ছাত্রনেতাদের দিয়ে থাকেন, তবে নিজের জন্য কত কমিশন রেখেছেন, তা সাধারণ মানুষের ভাবনার অতীত বোধ করি। বিষয়টা পুরোপুরি প্রমাণিত হয়তো হয়নি; কিন্তু দেশের মানুষের কাছে সব পরিস্কার হয়ে গেছে। এখানেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন; কিন্তু তিনি মাটি কামড়ে পড়ে আছেন উচ্চমহলের নির্দেশের অপেক্ষায়। কারণ পদ হারালে তো ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাবে। একজন উপাচার্য ভর্তিযুদ্ধের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে বিনা পরীক্ষায় কিছু নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে নিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পাস শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা বাবদ ১২ কোটি টাকা আয় করেছে। এই টাকার অঙ্কই বলে দেয়, এখানে ভর্তির জন্য অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা কতটা আগ্রহী। অথচ দলের স্বার্থে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহাশয় নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিতে এতটুকু দ্বিধা করলেন না।

দেশের আরও একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে আদর্শবান করতে গিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারার পর গণআন্দোলন ও গণধিক্কার এখন তুঙ্গে। অথচ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে উপাচার্য সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, 'আমি কোনো অপরাধ করিনি; পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না।' তিনি অন্য সবার মতো একজন রঙিন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাই রঙিন আদর্শ রক্ষার দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়েছে। রঙের দলদাস হিসেবে সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিতেই পদ ধরে আছেন। তিনি নিষ্ফ্ক্রিয় থেকে, নির্লিপ্ত থেকে, ধামাধরা থেকে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে সারাদেশে গণআন্দোলন হলেও তিনি নিজেকে রংহীন ভাবতে রাজি নন। সামগ্রিক বিবেচনায় বিষয়টিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন-কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ বলে মনে হলেও রঙিন মানুষদের তা বিশ্বাস হয় না। এটাও বোধ করি সারাদেশের মানুষ লক্ষ্য করেছে। আরও একজন উপাচার্য তো সবার চেয়ে এগিয়ে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন- সরকারদলীয় অঙ্গ সংগঠনের প্রধানের দায়িত্ব পেলে তিনি তাৎক্ষণিক উপাচার্যের পদ ছেড়ে দিয়ে অঙ্গ সংগঠনটির প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে নেবেন। এর আগেই তিনি দেশের প্রথম যুব উপাচার্য হিসেবে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এখন উপাচার্যের পদ ছেড়ে যদি অঙ্গ সংগঠনপ্রধানের পদ নেন, সেটা হবে দ্বিতীয় রেকর্ড।

হায় রে রাজনীতি! হায় রে আমার সব সম্ভবের দেশ! সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, এহেন আচরণে সারাদেশের মানুষ বিস্মিত হলেও ক্ষমতার বলয় বস্তির ঝগড়ার মতো যুক্তি দিয়ে চলেছে। অতীত বলে, জয় বস্তিরই হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত উপাচার্যদের অত্যাশ্চর্য সমাচার এমনই। ভেতরে হয়তো এমন আরও খবর আছে প্রকাশের অপেক্ষায়। সাধারণ মানুষ এসব খবর শুনতে চায় না। তারা এখনও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে চায়।

এম আর খায়রুল উমাম : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি)।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060620307922363