এই শিক্ষার উপযোগিতা কী?

মনজু আরা বেগম |

শিক্ষাই একটা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া একটা জাতি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখছি শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থাৎ আমাদের মেরুদণ্ডের কী হাল হয়েছে এবং হচ্ছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা কী শিখছে? শিক্ষার নামে এ কেমন বাণিজ্য চলছে? শিক্ষা কি অধিকার, নাকি বাণিজ্য? আমাদের মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেয়ার সুদূরপ্রসারী এ এক নীলনকশা চলছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত করা হচ্ছে, নাকি শিক্ষার নামে পণ্য বাণিজ্যিকীকরণ চলছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা আর নাইবা বললাম। দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে শ্রেণীবিন্যাস এবং বিরাট বৈষম্য। আমাদের সংবিধানে ১৭ (ক) ধারায় বলা আছে, রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর নেই। দেশে বর্তমানে মোটা দাগে ৩ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। সাধারণ শিক্ষা, ইংলিশ মিডিয়াম এবং মাদ্রাসা শিক্ষা। সাধারণ স্কুল বা কলেজে নিুমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বিত্তবানদের এবং মাদ্রাসায় গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়ে। ইংলিশ মিডিয়াম ও মাদ্রাসায় বাংলাকে প্রায় অবজ্ঞা করা হয় বলা যায়।

এখানে শিক্ষার্থীদের দেশাত্মবোধ ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, যা আমাদের সংবিধান পরিপন্থী। সাম্প্রতিক সময়ে অধ্যাপক আবুল বারকাতের প্রকাশিত বাংলাদেশে মৌলবাদ গ্রন্থের তথ্যমতে বাংলাদেশে মোট মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। আর মূল ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ৫০ লাখ। অর্থাৎ দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২৮ শতাংশই মাদ্রাসাগামী। এটি একটি উদ্বেগজনক তথ্য। দেশে মোট মাদ্রাসার সংখ্যা ৫৫ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ৭৩ শতাংশ কওমি মাদ্রাসা। এসব মাদ্রাসা পরিচালনায় বছরে ব্যয় হয় আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। মাদ্রাসা শিক্ষিতদের বেকারত্বের হার ৭৫ শতাংশ। দেশের একটি শীর্ষ দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যমতে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমে পঞ্চম শ্রেণীর ওপর থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষা শেখানো হলেও বাংলা ভাষা শেখানো হয় না। অধিকাংশ মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত শেখানো হয় না।

আমরা দেখছি, যে অভিভাবকরা সন্তানের পেছনে যত বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারবে, তার সন্তান তত বেশি বাজারে বিকোবে। নামের পাশে বড় বড় ডিগ্রির সার্টিফিকেট বাজারে সুলভ মূল্যে কিনতে পাওয়া যায়। কাজেই এত কষ্ট করে জ্ঞান অর্জনের দরকার কী? সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা দেশ ও জাতির জন্য একটা বিরাট উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে এ সংস্কৃতির আবর্তে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। এ থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকার এ অনৈতিক ও অপসংস্কৃতিকে কোনোভাবেই রোধ করতে পারছে না। একটা শিক্ষার্থীর গড়ে ওঠার যে ভিত, সে ভিতে একটা বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। প্রাথমিক লেভেল থেকে পিএসসি কিংবা চাকরির ইন্টারভিউ কোনো স্তরেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া বাদ যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে এসেছে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই এর উত্তর জানা যাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত আছেন, তারা অবলীলায় জানতে পারবেন দেশে শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।

ফেসবুকে দেখলাম কোনো এক স্কুলে জিপিএ-৫ পাওয়া কয়েকজন ছাত্রের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি তো জিপিএ-৫ পেয়েছ, বল তো জিপিএ ফাইভ মানে কী? দু’তিন জনকে জিজ্ঞেস করলেও এর জবাব দিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, একজন ছাত্রকে সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, বল তো আমাদের স্বাধীনতা দিবস কবে? ছেলেটি অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর জবাব দিল ১৬ ডিসেম্বর। অতঃপর সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন আমাদের বিজয় দিবস কবে? ছেলেটি জবাব দিল ২৫ মার্চ। এরপর সাংবাদিক মহোদয় আরও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে করলেন, এর মধ্যে একজনকে বললেন, বল তো আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি কে? এর জবাবও সে দিতে পারেনি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে এটা সত্যি না বানানো কোনো কল্পকাহিনী। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া একটি ছাত্র সাধারণ মানের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না এটা বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা না।

আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে কী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে? অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয়, বিশেষ করে গ্রামের স্কুলগুলোয় সবার কথা বলব না, আমার জানামতে অনেক শিক্ষক সময়মতো স্কুলে উপস্থিত থাকেন না। সংসারে কাজের ফাঁকে এটাকে সাবসিডিয়ারি কাজ ভেবে সেভাবেই স্কুলের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে একটা শিক্ষার্থীর গড়ে ওঠার ভিত। ভিত যদি মজবুত না হয়ে দুর্বল হয়, তাহলে সেটা টিকে থাকবে কিসের ওপর? উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, যতদূর মনে পড়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি কোনো এক প্রাইমারি স্কুল ভিজিট করতে গিয়ে ক্লাস ফোরের এক ছাত্রকে বলেছিলেন, তুমি কোন ক্লাসে পড়? ছেলেটি বলেছিল ক্লাস ফোরে। তিনি ইংরেজিতে ফোর বানান করতে বলেছিলেন, কিন্তু ছাত্রটি তা পারেনি। তিনি রেগে গিয়ে সম্ভবত স্কুল শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এ থেকেই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, আমাদের শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যথার্থই বলেছেন, ‘যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেশের আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় জড়িত, তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে দেয়া উচিত’। সন্তানের সাফল্যের প্রত্যাশায় অভিভাবকদের নৈতিকতা বিসর্জন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। আমাদের অভিভাবকরাও সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে কিনা, তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, দেশাত্মবোধ, শিষ্টাচার, ধর্মীয় আচার-আচরণ, ন্যায়-অন্যায় বোধ জাগ্রত হচ্ছে কিনা, দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য তারা কী অবদান রাখতে পারবে সেটা জানার বা শেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে যেটা বড় প্রয়োজন সেটা হল, যে কোনো মূল্যে একটা জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ পেতে হবে। এ জন্য ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র যত চড়া মূল্য দিয়েই হোক না কেন সন্তানের হাতে তুলে দিতে হবে। এ অসুস্থ ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এ জাতি এক সময় অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে, আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, আরও উত্তরোত্তর বাড়বে; কিন্তু আমরা এক সময় মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হব। সে সময় মনে হয় খুব বেশি দূরে নয়।

কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যাতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে এবং যে কোনো অন্যায় ও নীতিবিবর্জিত কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে, সে জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোয় প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রের নৈরাজ্য অবিলম্বে দূর করে গণমুখী শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার অবিলম্বে পরিবর্তন আনতে হবে। মাদ্রাসাগুলোয় কী ধরনের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, সেগুলো দেখভাল করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা ক্ষেত্রের নৈরাজ্য অবিলম্বে দূর করা না হলে আমরা যত উন্নতিই করি না কেন, দেশ যত এগিয়ে যাক না কেন, তা যে একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই সময় থাকতে বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা।

মনজু আরা বেগম : লেখক ও গবেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0021979808807373