কালজয়ী রম্যলেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘পাদটিকা’ গল্পে তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ আমলের একজন শিক্ষকের দরিদ্রতার করুণ চিত্র— পণ্ডিতমশাই ক্ষোভে, দুঃখে হুংকার করে সহজ অথচ পৃথিবীর কঠিনতম গাণিতিক সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন ছাত্রদের কাছে। ছাত্ররা লজ্জায় অবনত শিরে বসেছিল সেদিন। পণ্ডিত মশাইয়ের শত শত ছাত্র লেখাপড়া শিখে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটিশদের তাড়িয়েছে, কিন্তু ভুলে গেছে পণ্ডিত মশাইয়ের ছোট গাণিতিক সমস্যার সমাধান দেওয়ার কথা। শনিবার (৩ আগস্ট) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এ নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন হুমায়ুন কবির।
০২.
ব্রিটেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইকোনোমিক এবং সোশ্যাল রিসার্চের এক গবেষণায় ‘শিক্ষকের মর্যাদা সূচক’ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে চীন তালিকার সবচেয়ে ওপরে। চীনের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে। এশিয়ার অন্যান্য দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। আর এদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের কতটুকু মর্যাদা দেওয়া হয়?
০৩.
দেশের উন্নতি নির্ভর করে যে শিক্ষার ওপর—তার প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক স্তর। ভিত যদি দুর্বল হয়, তাহলে বাদবাকি শিক্ষাও নড়বড়ে হতে বাধ্য।
শিক্ষক একজন শিল্পী। তিনি প্রতিনিয়ত শিষ্যের মাঝে সৃষ্টির আনন্দ, বেঁচে থাকার পথ খোঁজেন। শিক্ষকই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি মা-বাবার পরে তাঁর চেয়েও অসীম উঁচুতে তাঁর সৃষ্টিকে দেখতে চান। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবি ঠাকুরের ‘ব্যবধান’ গল্পের সেই উক্তি মনে পড়ে যায়—‘হূদয়ের সর্বপ্রথম স্নেহরস দিয়া যাহাকে মানুষ করা গিয়াছে, বয়সকালে যদি সে বুদ্ধি জ্ঞান এবং উন্নত স্বভাবের জন্য শ্রদ্ধার অধিকারী হয়, তবে তাহার মতো এমন পরমপ্রিয় বস্তু পৃথিবীতে আর পাওয়া যায় না।’
২৩ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশনের প্রস্তুতি নিয়ে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা একত্রিত হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। লড়াইটা যতটা না ছিল অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি নৈতিক। শিক্ষক শব্দটার সঙ্গে সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ, উন্নত জীবনমান প্রভৃতি শব্দ চলে আসে। শিক্ষককে শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত করার দায় তাঁর ছাত্রদেরই নিতে হবে। তাদের এখন অবতীর্ণ হতে হবে ‘একলব্য’র ভূমিকায়। শিক্ষকরা শহীদ মিনার ছাড়লেও গুরুদক্ষিণার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। একলব্য! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ গুরুর দীর্ঘশ্বাস?
০৪.
প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্যের জালে পচন ধরে গেছে। অতি দ্রুতই সুতা ছেঁড়ার শব্দ শোনা যাবে। আমাদের ভাইবোনেরা লড়াই শুরু করেছেন। আমার মনে হয় প্রত্যেকের যার যার অবস্থান থেকে লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া উচিত। সুতরাং অলস বসে থাকার সময় নেই। অতি ভদ্রতা দেখিয়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হওয়ার সময় নেই। জীবন কি এতই প্রিয় আর শান্তি কি এতই মধুর যে, বৈষম্য আর দাসত্বের দামে তাকে কিনতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে, আমি জানি না অন্যরা কোন পথ বেছে নেবে। কিন্তু আমি প্যাট্রিক হেনরির মতো বলব—‘আমাকে বৈষম্য থেকে মুক্তি ও মর্যাদা দাও, নয়তো মৃত্যু।’
যথাযথ কর্তৃপক্ষের শুভদৃষ্টির উদয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষকদের ১০ম ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের দ্রুত বাস্তবায়ন হোক।
ময়মনসিংহ