কলেজ ও মাদরাসায় একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রথম ধাপের আবেদন শেষ হয়েছে। কিন্তু প্রথম ধাপে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর অজান্তে তাদের কলেজ ভর্তির আবেদন করা হয়েছে। পেশাদার ভর্তি-দালাল চক্রের সহায়তায় মানহীন কিছু সংখ্যক কলেজ শিক্ষার্থীদের না জানিয়েই তাদের নামে ভর্তির আবেদন করে দিয়েছে। ভর্তিচ্ছুরা অনলাইনে আবেদন করতে গিয়ে জানতে পারছেন তাদের আবেদন হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ ও হতাশ ভর্তিচ্ছুরা শিক্ষাবোর্ডে সশরীরে হাজির হয়ে বিষয়টি জানালে তাদের সমস্যার সমাধানও হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অজান্তেই আবেদন করা অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রতারকদের খুঁজে বের করা যাচ্ছে না। খুঁজে বের করার সক্ষমতাও নেই কর্তৃপক্ষের। আবেদন গ্রহণ থেকে শিক্ষার্থী বাছাই পর্যন্ত পুরোটাই অনলাইনে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আবেদন প্রক্রিয়াকরণের। একটা নির্ধারিত সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
অনিয়ম, ভোগান্তিসহ নানা সমস্যা এড়াতে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অনলাইনে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন নেয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও অনলাইনে একাদশে ভর্তির আবেদন গ্রহণ হয়েছে। কিন্তু পদ্ধতিগত দুর্বলতায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অনলাইনে একাদশে ভর্তির আবেদন গ্রহণ শুরুর পর থেকেই শিক্ষার্থী না পাওয়া কলেজগুলোর বিরুদ্ধে এসএসসি উত্তীর্ণদের অনুমতি ছাড়াই তাদের তথ্য সংগ্রহ করে কলেজে ভর্তির আবেদন করার অভিযোগ রয়েছে।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে একদশ শ্রেণিতে ভর্তির প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের অজান্তে আবেদন হয়েছে সাড়ে পাঁচ শতাধিক। এসব শিক্ষার্থী অনলাইন আবেদন করতে গেলে দেখতে পেয়েছেন তাদের আবেদন আগেই হয়ে গেছে।
বোর্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একাদশে ভর্তির প্রথম ধাপে ১৫ লাখ ৬০ হাজারের বেশি এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন। কিন্তু সে তুলনায় শিক্ষার্থীদের অজান্তে করা আবেদন কম। তবুও তারা কোনো কলেজ এ ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে বোর্ড। কিন্তু কর্মকর্তারা বলছেন, ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের অজান্তে আবেদন করা কলেজগুলো খুঁজে বের করা যাবে না।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘এবার একাদশে ভর্তির শিক্ষার্থীদের অজান্তে হওয়া আবেদন বেশ কম। প্রতিবছর কয়েক হাজার আবেদন হলেও এবার সে সংখ্যা কম। সাড়ে পাঁচশর মত এমন আবেদন হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কেউ ভুল করে আবেদন করেছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধুরা আবেদন করেছেন।
কিন্তু বাকি যেসব শিক্ষার্থী আবেদন করতে গিয়ে দেখেছেন তাদের আবেদন হয়ে গেছে, তাদের জটিলতা সমাধান করা হয়েছে। কিন্তু কারা তাদের আবেদন করে ফেলেছে সে নম্বর পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে কোনো কলেজ সম্পৃক্ত কী-না তা খুঁজে বের করা যাচ্ছে না।’তিনি বলেন, ‘এর মূল কারণ একজন শিক্ষার্থী ৫ থেকে ১০টি কলেজ চয়েস দেয়ার সুযোগ পায়। কোনো কলেজের পক্ষ থেকে যদি শিক্ষার্থীর অজান্তে আবেদন করে দেয়া হয়, সে হয়তো কৌশলগত কারণে তার নামটি সবার প্রথমে দেবে না। আর আবেদন করা ১০টি কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না। তাই কোন কলেজ শিক্ষার্থীদের না জানিয়ে আবেদন করে ফেলছে তা সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করা যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক আবু তালেব মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘ আমরা যে সাড়ে পাঁচশ নম্বর চিহ্নিত করেছি সেগুলোর মধ্যে দুইশর মত আবেদন করা হয়েছে ভুলে। বাকি থাকে সাড়ে তিনশ নম্বর। যে নম্বর থেকে শিক্ষার্থীদের অজান্তে হওয়া আবেদন করা হয়েছে। আমাদের যদি প্রতিষ্ঠান থাকে ১০ হাজার আর শিক্ষার্থী থাকে ২০ লাখ সে তুলনায় এ সংখ্যা একদমই কম।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে যেসব শিক্ষার্থী তাদের জটিলতার কথা জানিয়েছেন আমরা সবার সমস্য সমাধান করে দিয়েছি। একজন শিক্ষার্থীও নেই যাদের জটিলতা আছে। কিন্তু কোনো কলেজ যদি শিক্ষার্থীকে না জানিয়ে আবেদন করে তাহলেও আমরা তা খুঁজে বের করতে পারবো না। কারণ আবেদনে ৫ থেকে ১০টি চয়েস দেয়া হয়েছে। কেউ ফেইক আবেদন করলে সে নিজের কলেজকে প্রথমে রাখবেন না। আর তার চয়েসের সবগুলো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়া আবেদন করার অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়াও যায় না।’
বোর্ড জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অজান্তে আবেদন করা প্রমাণ পেলে কলেজের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং কলেজের প্যানেল বা সার্ভার বন্ধ করে তাদের পাঠদান স্থগিত করা হবে। আর শিক্ষার্থীদের সচেতন থাকতে বলেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো।
যদিও শিক্ষার্থীদের অজান্তে আবেদন করা কলেজগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি ও তাদের চিহ্নিত করতে না পারার সক্ষমতাকে প্রহসন বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, তারা একবার বলছে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব, পরে বলছেন চিহ্নিত করতে পারছি না। এমন চলতে থাকলে প্রতিবছরই ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের এ ধরণের ভোগান্তিতে পড়তে হবে। সরকার শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখতে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে করোনা মহামারির সময় থেকে সরকার অনলাইনে ভর্তিতে জোর দিয়েছে। কিন্তু সাড়ে পাঁচশ শিক্ষার্থীকে যদি আবেদন করতে না পেরে বোর্ডে ছুটে যেতে হয়, সেক্ষেত্রে অনলাইনে ভর্তির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এসএমএস ও অনলাইনে দুই পদ্ধতিতেই একাদশ শ্রেণিতে কলেজে ভর্তির আবেদন দেয়া হতো। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অজান্তে আবেদন বন্ধ করতে গত ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে এসএমএসের মাধ্যমে আবেদনগ্রহণের প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়। এতেও বন্ধ হয়নি প্রতারণা ও ভোগান্তি। সফটওয়্যার দুর্বলতায় দোষীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
গতকাল ১৭ জানুয়ারি প্রথম ধাপের আবেদন শেষ হয়। প্রায় ১৬ লাখ ভর্তিচ্ছু আবেদন করেছেন ।