আজ থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো বই উত্সব ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২০’ শুরু হবে। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। প্রতি বছর এই গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমি প্রান্তরের সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এই বই মেলার প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর, কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা প্রথম বই। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে তার দেখাদেখি অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তত্কালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৪ সালে মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ২০১৪ সাল থেকে এই গ্রন্থমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মাঠে ব্যাপক আয়োজনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বইমেলা মানে জ্ঞানের মেলা। যেখানে প্রবীণ, তরুণ, আবাল-বৃদ্ধ সবার জ্ঞানের সমাহারে সৃষ্ট জ্ঞান কালো অক্ষরে বাঁধাই করা হয় সাদা কাগজে মোড়ানো বইয়ের মাঝে। বইমেলা মানে বইপ্রেমী পাঠকদের জন্য এক অনন্য আনন্দের মেলা। তীব্র জ্ঞানক্ষুধা আহরণের মেলা। যেখানে বইপ্রেমী পাঠকরা ভার্চুয়াল জগত্ থেকে বেরিয়ে এসে ভিড় জমায় বইমেলায় তাদের প্রিয় লেখকের বই কেনার জন্য। কিন্তু বড়োই অনুতাপের বিষয়, বাংলা সাহিত্যের অনন্য নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আহমদ ছফা, হুমায়ূন আহমেদসহ অন্যান্যের পর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য লেখকের আবির্ভাব ঘটেনি; যা বই পড়ুয়া পাঠকদের জন্য চরম উদ্বেগ এবং কিছুটা হতাশার বিষয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি আমাদের দেশে দিন দিন মেধাবীরা হারিয়ে যাচ্ছে? লেখক কি আমাদের দেশে আর জন্ম নিচ্ছে না! উত্তর ‘হ্যাঁ’ আমাদের দেশে অনেক মেধাবী আছে এবং অনেক উদীয়মান লেখক আছেন। যারা প্রতিনিয়ত আমাদের জন্য নতুন নতুন সৃজন করার জন্য ব্যস্ত থাকেন। এজন্য প্রতি বছর আমরা বইমেলার সময় দেখতে পাই যে, আমাদের দেশে কিছু তরুণ উদীয়মান লেখকের আবির্ভাব ঘটে, যারা অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে তাদের লেখা বই গ্রন্থমেলাতে প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু তরুণ এবং অপরিচিত লেখক হিসেবে পাঠকেরা সেসব বইয়ের সঠিক মূল্যায়ন কিংবা কিনতে আগ্রহী হয় না। যার ফলে সেই উদীয়মান তরুণ-লেখক তার লেখালেখির স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন।
কারণ, তার লেখার সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। এভাবে তিনি হতাশা-আক্রান্ত হয়ে সাহিত্যচর্চা কিংবা লেখালেখি ছেড়ে দেন। এতে হারিয়ে যায় একটি সুপ্ত প্রতিভা। হারিয়ে যায় তারুণ্যের বিকাশধারা। আমরাও হারিয়ে ফেলি এক অনন্য সুপ্ত আবিষ্কারকে। যার ধারাবাহিকতা সেই আদি থেকে শুরু হয়ে আসছে। আমাদের চোখের সামনে যত্নের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মেধাবীর সুপ্ত জ্ঞানের ধারা।
আমরা জানি, এদেশে আর কখনই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, ছফা, হুমায়ূন এবং অন্যান্যরা জন্মাবে না। কিন্তু তাই বলে কি আর তাদের মতো লেখক আর পাব না! উত্তর ‘হ্যাঁ’ অবশ্যই আমরা তাদের মতো জ্ঞানী-গুণী লেখক পাব। কেননা, তাদের প্রতিভার মতোই আরো অনেক প্রতিভাবান প্রতিনিয়ত জন্মাচ্ছে এবং জন্মাবে আমাদের দেশে। শুধু আমরা তাদের সঠিক মূল্যায়ন করলেই জ্ঞানের জগতে সৃজনশীলতা দিয়ে তারা অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠবে। তাই আমাদের উচিত নতুনদের অবহেলা করা নয়, অবমূল্যায়ন করা নয় বরং তাদের অনুপ্রাণিত করা। নতুনদের সৃষ্ট কোনো বিষয়ে ভুল হলে সেটা পেছন থেকে সমালোচনা না করে তার সামনে উপস্থিত থেকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া। প্রতি বছরের মতো এ বছরও অমর অকুশে গ্রন্থমেলায় (২০২০) অনেক প্রতিভাবান তরুণ লেখকরা আশা নিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশ করবে। আমাদের উচিত, সে সব বই ক্রয় করা তরুণ উদীয়মান প্রতিভাবান লেখকদের খুঁজে বের করে আনা। সে সব তরুণ লেখককে আরো নতুন কিছু সৃষ্টি করার অনুপ্রেরণা দান করা। আমরা জানি, একজন লেখককে তখনই মূল্যায়ন করা হয়, যখন সে লেখকের বই বাজার থেকে পাঠকরা ক্রয় করে। তাই সর্বশেষ কথা, তরুণদের অবমূল্যায়ন নয়, সুস্থ মূল্যায়নের মাধ্যমেই এবাবের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিকশিত হোক হাজারো তরুণ ভাবনার।
জসিম উদ্দীন : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।