মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পর এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাব ব্যবহার করে হুন্ডির টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) পরীক্ষামূলকভাবে সন্দেহজনক চারটি হিসাব যাচাই করে তিনটিতেই হুন্ডির প্রমাণ পেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবহার করে সারাদেশে কী পরিমাণ হুন্ডি হচ্ছে, তা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএফআইইউ। সতর্ক এবং কর্মপন্থা ঠিক করতে এরই মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকা ১০টি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের দায়িত্বে থাকা বিশেষায়িত এ ইউনিট। সোমবার (৮ মে) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ওবায়দুল্লাহ রনি।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বিএফআইইউর প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, নোয়াখালীর চাটখিলের রেজ্জাকপুরে আদর্শ টেলিকম এবং বাবর টেলিকম নামে পাশাপাশি দুটি দোকান ভিন্ন দুই মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট। তারা স্থানীয় দুটি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটে হিসাব খোলে। এ হিসাবে মূলত হুন্ডির টাকা পেত তারা। এর পর সুবিধাভোগীর চাহিদা অনুযায়ী কখনও আরেক হিসাবে স্থানান্তর করত। কখনও সেখান থেকে নগদ টাকা দিত। বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবেও টাকা পাঠাত। গত দুই বছরে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ দুটি এজেন্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে ৫২ কোটি টাকা স্থানান্তর হয়েছে। বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৮ এপ্রিল দুটি দোকানের স্বত্বাধিকারীকে আটক করে সিআইডি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করেছেন।
বিএফআইইউর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশের বাইরে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে দেশে সুবিধাভোগীর কাছে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। যারা বিদেশে অর্থ পাচার করে, তারা হুন্ডি কারবারিদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কেনে এবং এর বিপরীতে দেশে টাকার জোগান দেয়। এসব টাকার পুরোটা একসময় ‘ক্যাশ’ লেনদেন হতো। এখন এমএফএস বা এজেন্ট ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মও ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, এমএফএসের পর কয়েকটি এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাবের তথ্য বিশ্লেষণ করে সন্দেহজনক হুন্ডি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এমএফএস, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে হুন্ডি কারবারিরা যেন অবৈধ লেনদেন করতে না পারে, তার জন্য কঠোর তদারকি অব্যাহত থাকবে।
জানা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে হুন্ডি ঠেকাতে গত ১০ এপ্রিল এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে শীর্ষে থাকা ১০টি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে বিএফআইইউ। সেখানে এ প্রবণতা ঠেকাতে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। সারাদেশের ২১ হাজারের বেশি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং এসব এজেন্টের আওতায় খোলা সব হিসাবের অনলাইন তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এর পর নির্দিষ্ট একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট আলাদা করা হবে। সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত প্রতিটি হিসাব আবার যাচাই করে আইনি ব্যবস্থার জন্য পাঠানো হবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এজেন্ট ব্যাংকিং বা প্রতিনিধি ব্যাংকিংয়ের অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের শাখা নেই এসব এলাকায় নিজস্ব বিক্রয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে এমন ব্যক্তি ব্যাংকের পক্ষে এ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। পার্শ্ববর্তী নির্ধারিত ব্যাংক শাখার আওতায় এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট কাজ করে থাকে। শুধু বৈদেশিক মুদ্রা কার্যক্রম ছাড়া নির্ধারিত শাখার পক্ষে এজেন্টরা আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ এবং চেক বইয়ের আবেদন নিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সাম্প্রতিক ডলার সংকটের অন্যতম কারণ প্রবাসী আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ বৈধ চ্যানেলে না আসা। কর ফাঁকির জন্য আন্ডার ইনভয়েসিং কিংবা দুর্নীতির অর্থ বাইরে নিতে ব্যাংকের তুলনায় বেশি দর দিয়ে কিনে নেয় হুন্ডি চক্র। হুন্ডি ঠেকাতে দেশের ভেতরে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার ঠেকাতে গত বছরের জুলাই থেকে আমদানির তথ্য তদারকি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামীতে রপ্তানির তথ্যও তদারকি করা হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর সম্প্রতি জানিয়েছেন।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ইসলামী ব্যাংক দেশের একমাত্র ব্যাংক যারা অনেক আগে থেকে বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি পাঠিয়ে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করে আসছে। প্রতিনিধিদের প্রধান কাজ হলো, হুন্ডিতে অর্থ না পাঠিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে সচেতনতা বাড়ানো। এসব কারণে দেশের মোট প্রবাসী আয়ের ৩০ শতাংশের মতো এখন ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে আসছে। তিনি বলেন, সব ধরনের কমপ্লায়েন্সের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক সব সময় সতর্ক। হুন্ডি প্রতিরোধে তাঁদের বাড়তি সতর্কতা রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রধান কার্যালয়ের আইটি বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কেউ যেন কোনো ধরনের সন্দেহজনক লেনদেনের সুযোগ না পায়, সে জন্য জোর তদারকি করা হয়।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আগে মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম অপব্যবহারের কিছু ঘটনা উদ্ঘাটন করা হয়। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে হুন্ডি চক্রের সদস্য সন্দেহে গত মার্চ পর্যন্ত সারাদেশের ৫ হাজার ৭৬৬ জন এমএফএস এজেন্টের এজেন্টশিপ বাতিল হয়েছে। এসব এজেন্টের তথ্য সিআইডিতে পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। হুন্ডিতে টাকা আনার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গত মার্চ পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৮৫৬ জন সুবিধাভোগীর হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এদের মধ্যে বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে আবার ৪ হাজার ২২৪টি হিসাব সচল করা হয়েছে। আগামীতে যেন আর এ উপায়ে টাকা না আনে– সে প্রতিশ্রুতি নিয়ে হিসাব সচল করা হয়। তবে সতর্কতার পরও অনেকে নতুন নামে এমএফএস হিসাব খুলে হুন্ডিতে টাকা আনছে বলে জানা গেছে। কেউ কেউ আগে নিয়মিত হুন্ডিতে টাকা আনত। কিন্তু এখন বৈধ চ্যানেলে আনছে। আনব্লকড হিসাবধারীদের মধ্য থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ৬০৮ জন বৈধ চ্যানেলে ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এনেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক দিন ধরে কৃত্রিম উপায়ে দর ধরে রাখায় ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের দর বেড়ে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ১১০ থেকে ১১৪ টাকায় ওঠে। তবে গত সেপ্টেম্বর থেকে সব ব্যাংকে এক দর বেঁধে দেওয়া হয়। এখন প্রবাসীরা প্রতি ডলারে পাচ্ছেন ১০৮ টাকা। আর রপ্তানিতে দর ১০৬ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক বিক্রি করছে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা। দর নিয়ন্ত্রণের পর থেকে রেমিট্যান্স কমছে। গত মার্চে কোনো কোনো ব্যাংক ১০৭ টাকা ঘোষণা দিয়েও ১১৩ টাকা পর্যন্ত দরে ডলার কিনেছিল। এর প্রভাবে টানা ৬ মাস পর মার্চে রেমিট্যান্স আবার ২ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়িয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি জোরদারের পর আগের মাস ও আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১৬ শতাংশের বেশি কমে এপ্রিলে ১৬৮ কোটি ডলারে নেমেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার মূল কারণ হুন্ডি।