এনটিআরসিএ : বিচারাধীন দুই হাজার পদে নিয়োগের তৎপরতা, নানা প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক |

দুই হাজার দুশো ৭ জন নিবন্ধিত প্রার্থীর নিয়োগ সুপারিশের বিষয়টি বিচারাধীন থাকার পরেও তাদের নিয়োগ সুপারিশ করার উদ্যোগ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।  এনটিআরসিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কতিপয় আইনজীবী এবং শিক্ষক নিবন্ধনধারীর সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট বিচারাধীন থাকা এসব পদে নিয়োগ সুপারিশ করানোর তোড়জোড় শুরু করেছেন। এর পেছনে অর্থযোগের বিষয়ও রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রার্থীদের অভিযোগ এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন এনটিআরসিএর দুইজন কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন কর্মচারী। সাধারণ প্রার্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন। তারা দৈনিক শিক্ষাকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছেন। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

তবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা দৈনিক শিক্ষাকে বলছেন, বিচারাধীন বিষয়ে নিয়োগ সুপারিশ করার সুযোগ নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবেও দৈনিক শিক্ষাকে আশ্বস্ত করেছেন তারা। 

দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, আপিল বিভাগের রায়ের দোহাই দিয়ে ১৩ তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও সেই রিটে অংশ নেয়া নিয়োগপ্রত্যাশী দুই হাজার দুশো সাতজন প্রার্থীর মধ্যে অনেকের কাছ থেকে নিশ্চিত নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত তুলে নিয়েছে চক্রটি।  

মাঠপর্যায় থেকে অভিযোগ উঠেছে, টাকা দেয়া নিয়োগ প্রত্যাশীরা ইতোমধ্যে জানতে পারছেন তারা কোন পদে কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছেন। আদালতের দোহাই দিয়ে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এমনই অবৈধ বাণিজ্য চলছে। সাধারণ প্রার্থীরা তদন্ত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর কাছে দাবি জানিয়েছেন। 

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

জানা গেছে, ১৩ তম প্রার্থীদের নিয়োগ সুপারিশ করতে রায় দিয়েছিল আপিল বিভাগ। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মার্চ দেয়া সেই রায়ে আপিল বিভাগ ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২ হাজার ২০৭ জনকে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশনা দেয়। তবে সেসময় এনটিআরসিএর কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ১৬৬টি রিটের রায়ে এনটিআরসিএকে সমন্বিত মেধাতালিকা করে নিয়োগের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আদালত ১৬৬টি রিটের শুনানিতে এক নির্দেশনা দিলেও পরে ১৩তম নিবন্ধনের প্রার্থীদের করা রিটের আদেশে রিটকারীদের নিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছে। দুইরকম নির্দেশনা থাকায় নিয়োগ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় আপিল বিভাগের রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করে এনটিআরসিএ। রিভিউ আবেদনের নম্বর ১৯৫/২০২০। তবে, করোনা মহামারির কারণে রিভিউ আবেদন শুনানির দিন তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। রিভিউ আবেদনটি গ্রহণ হওয়ায় বিষয়টি বিচারাধীন আছে  বলে মত দিয়েছেন দৈনিক শিক্ষার আইন উপদেষ্টারা। 


   
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সে সময় আপিল বিভাগের রায়, রিভিউ আবেদন ও গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে যে দুই হাজার ২০৭ জন প্রার্থীকে নিয়োগ সুপারিশের নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাদের জন্য পদ সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছিল আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই কর্মকর্তারা প্রার্থীদের একটি চক্রের সাথে আঁতাত করে এই ২ হাজার ২০৭ জন প্রার্থীকে নিয়োগ সুপারিশ করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। পদ সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রার্থীদের আবেদনও নেয়া হয়েছে। বিচারাধীন থাকা পদগুলোতেই এখন তাদের নিয়োগ দিতে তোড়জোড় চলছে। 

সাধারণ প্রার্থীরা বলছেন, এ ২ হাজার ২০৭ জন প্রার্থীর থেকে নিয়োগের আশা দিয়ে প্রতিজনের কাছ ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। তারা কয়েকদিন ধরে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে কোথায় নিয়োগ সুপারিশ পাবেন সে বিষয়টি বলে বেড়াচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এনটিআরসিএর বেশকয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পদ বেশ কয়েকদিন ধরে ফাঁকা আছে। একজন যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা সে পদগুলোর ভারপ্রাপ্ত সদস্য হিসেবে আছেন। জনবল সল্পতার সুযোগ নিচ্ছে সিন্ডিকেটটি। সিন্ডিকেটে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ নিয়োগ দিতে ওই সদস্যকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। চেয়ারম্যানের রদবদলে সে সুযোগে আরও একটু পরিষ্কার হয়েছে। এ ২ হাজার ২০৭ জন প্রার্থীর নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। 

এসব নিয়ে দৈনিক শিক্ষাডটকমের পক্ষ থেকে এনটিআরসিএর একজন সদস্যের মতমত জানার চেষ্টা করা হলে তিনি বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। 

এদিকে বিচারাধীন অবস্থায় নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ প্রার্থী ও এনটিআরসিএর সাবেক কর্মকর্তারা। সাধারণ প্রার্থীরা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলছেন, রিভিউ আবেদন করা হলে বিষয়টি বিচারাধীন। এ পর্যায়ে তাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এসব প্রার্থীরা নিবন্ধন পরীক্ষা ৪০ থেকে ৫৫ নম্বর পেয়ে নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন। আর ৭০ থেকে ৮০ নম্বর পেয়েও সাধারণ প্রার্থীরা নিয়োগ পাচ্ছেন না। এভাবে নিয়োগ হলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আগ্রহ হারাবেন। বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। 

আইনজীবীরাও বলছেন, বিচারাধীন বিষয়ে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নেই। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ জাহাঙ্গীর হোসেন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আপিল বিভাগের কোন রায় যদি রিভিউ আবেদন করা হয় তবে তা বিচারাধীন বিষয়। এ বিষয়ে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নেই। তবে, রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত আসলে সে বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। রিভিউ আবেদনের পর সে বিষয়ে কাজ পরিচালনার সুযোগ নেই। 

এদিকে এনটিআরসিএর সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, রিভিউ আবেদন করা হলে বিষয়টি বিচারাধীন। এ পর্যায়ে আবেদনটি নিষ্পত্তি না হলে সে কার্যক্রম পরিচালনা এখতিয়ার নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত অনুসারে পদ সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তবে, একদিকে রায়কে রিভিউ চেয়ে আবেদন ওপর দিকে সেই রায়ের আলোকে নিয়োগ একইসাথে হতে পারে না। যদি নিয়োগ দেয়াও হয় বিষয়টি আইনসম্মত হবে না। আর এনটিআরসিএ যদি এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুও করে, তাহলেও সম্পূর্ণ বিষয়টি হবে প্রশ্নবিদ্ধ।

এদিকে এ নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএর এক কর্মকর্তা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এই ২ হাজার ২০৭ জনের আবেদন নেয়া হয়েছে বিশেষ প্রক্রিয়ায়। তাদের সুপারিশের প্রস্তুতি আছে। উচ্চপদস্থদের নির্দেশনা অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। 

জানা গেছে, এনটিআরসিএর সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন দায়িত্ব ছেড়েছেন। আর নতুন চেয়ারম্যান এনামুল কাদির খান সবে যোগদান করেছেন। এ পরিস্থিতিতে এ  দুই হাজার ২০৭ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে তোড়জোড় চালাচ্ছেন অভিযুক্তরা।

এসব বিষয়ে দৈনিক শিক্ষাডটকমের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে নিয়োগ সুপারিশ করা হবে না। রিভিউ আবেদনের সিদ্ধান্ত আসলে সে সিদ্ধান্ত অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। 

উল্রেখ্য, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ  মাস থেকে কার্যকর হওয়া বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয় কর্তৃপক্ষ আইনের অধীনে এনটিআরসিএ সনদ দেয়া শুরু করে। এই সনদগুলো শুধু নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য। এক কথায় প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণী। মানে এই সনদ নিয়ে ফের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেয়া নিয়োগ পরীক্ষায় বসতে হবে। সেখানে উত্তীর্ণ হলেই নিয়োগপত্র,  যোগদান ও এমপিওভুক্তি।  কিন্তু ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর থেকে নিয়ম বদলে যায়। এ সময় থেকে এন্ট্রি লেভেলে নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় এনটিআরসিএকে। এই সময় থেকে যারা উত্তীর্ণ হচ্ছেন তাদেরকে  আরো কোনো পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে না। কিন্তু কতিপয় আইনজীবী ও পুরনো পদ্ধতির নিবন্ধন সনদধারী অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছেন। তারা দুই ধরণের সনদের তথ্য গোপণ করে পুরনো পদ্ধতির নিবন্ধন সনদধারীদেরকে রিট করে শিক্ষকতার মহান পেশায় প্রবেশের আশা দেখিয়ে পকেট কাটছেন। তারা এই মর্মে অপপ্রচার করছেন যে, নিবন্ধন সনদ থাকলেই তাকে নিয়োগ দিতে হবে।   


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040221214294434