সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ৫৫ বছর বয়সী সেই মো. বেলায়েত শেখ আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সফল না হলেও বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সফল হবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
বেলায়েত শেখ জানান, এবার বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিস ডিপার্টমেন্টে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে তিনি প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এ অর্জনই তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও লেখাপড়ার ইচ্ছা পূরণ হবে বলেন তিনি। পরীক্ষা দিতে তিনি এখন ওই এলাকায় অবস্থান করছেন।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখণ্ড এলাকার মৃত হাসেন আলী শেখ ও জয়গন বিবির চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান বেলায়েত শেখের কথা। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে তিনি বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও তার ভর্তির ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তারপরও তিনি ভর্তিযুদ্ধ থেকে সরে যাননি।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেয়া বেলায়েত, ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি ছিল আগ্রহ। প্রবল আগ্রহ থাকলেও দারিদ্রের কারণে তখন তা হয়ে উঠেননি তিনি। তিনি জানান, ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক পরীক্ষা (এসএসসি) যেই না মাত্র বসতে যাবে তখনই অসুস্থ হয়ে পড়েন তার বাবা হাসেন আলী শেখ। পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলাপের পুরও টাকা ব্যয় হয় বাবার চিকিৎসার পেছনে। পরবর্তীতে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাবেদ বন্যা আর ১৯৯১-৯২ খ্রিষ্টাব্দে মায়ের অসুস্থতার আর লেখাপড়া করা হয়নি। মা ভক্ত বেলায়েত মনে করেন, দুনিয়াতে মা বেঁচে না থাকলে এই লেখাপড়া দিয়ে কি হবে। লেগে পড়েন মাতৃসেবায়। কাঁধে নেন পুরো সংসারের দায়িত্ব।
এসএসসি দিতে না পারায় মেকানিক্যাল কোর্স করে মোটর গাড়ির ওয়ার্কশপ কাজ শুরু করেন, তা দিয়েই চলে সংসার। সঙ্গে ভাই-বোনদের পড়াশোনার দায়িত্ব পড়ে তাঁর কাঁধে। অভাবের মাঝে ভাই-বোনদের উচ্চ শিক্ষা দিতে না পেরে সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন বুনেন তিন সন্তানের জনক বেলায়েত শেখ। তার ইচ্ছা সন্তানরা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) উচ্চ শিক্ষা নেবে।
বড় ছেলে গাজীপুরের একটি কলেজ থেকে স্নাতকে পড়ছেন, সেই সঙ্গে মাওনা চৌরাস্তায় তাকে স্যানেটারির দোকান করে দিয়েছেন বেলায়েত শেখ। সম্প্রতি তাকে বিয়েও করিয়েছেন। একমাত্র মেয়েকে ঘিরে বেলায়েত শেখের ছিল সকল স্বপ্ন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার মায়ের পরে আমি আমার মেয়েকে অনেক ভালবাসতাম। স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে মেয়েটি আমার মুখ উজ্জ্বল করবে। হবে বিসিএস ক্যাডার। সেজন্য রাজধানীর নামকরা কলেজে ভর্তিও করিয়েছেন। কিন্তু মেয়ে সেখানে পড়াশোনা না করেই গ্রামে চলে আসে। সেখানে এইচএসসি শেষে একটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়। সকল স্বপ্ন যেন তখনই শেষ হয়ে যায়, বেলায়েত শেখ বলেন। ওই কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়েছে তার মেয়ে। এরপর তাকেও বিয়ে দিয়ে দেন। এদিকে বেলায়েত শেখের সবচেয়ে ছোট ছেলে বিগত মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছেন, তিনিও পড়ছেন একটি ইঞ্জিনিয়ারিংএ কলেজে।
তিন সন্তানই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) না পড়ার যন্ত্রণা বোধ করছেন বেলায়েত। সব অপ্রাপ্তি অপূর্ণতা সন্তান, ভাই-বোনের কাঁধ থেকে নামিয়ে নিজের কাঁধেই তুলে নেন বেলায়েত। শুরু করেন পড়াশোনা। চলতি বছরে ঢাকা মহানগর কারিগরি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি-ভোকেশনাল) জিপিএ ৪ দশমিক ৪৩ নিয়ে পাস করেন। এর আগে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাসাবোর দারুল ইসলাম আলিম মাদরাসা থেকে জিপিএ ৪ দশমিক ৫৮ পেয়ে মাধ্যমিক সমমান দাখিল (ভোকেশনাল) পাস করেন। উচ্চশিক্ষা অর্জনে এবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছেন তিনি।