এমপিওভুক্তি ও কিছু কথা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

প্রায় নয় বছর পর এক সাথে  দুই হাজার ৭৩০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সংবাদ দেশবাসীর জন্য বড় একটি সুসংবাদ বটে। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সত্যি এ সংবাদে আনন্দিত হয়েছি।আমাদের শিক্ষায় এটি এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিরাট এক মাইল ফলক। এ জন্য শিক্ষাবান্ধব সরকারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান এমপিও পেয়েছে, তাদের দুর্দশা আপাত কিছুটা লাঘব হবে। তাদের শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্তির খবরে উচ্ছ্বসিত। নতুন এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা সংশ্লিষ্ট এলাকায় আনন্দের জোয়ার। কমিটির লোকজনসহ প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সকলে এক রকম আনন্দে উদ্বেলিত। যেসব প্রতিষ্ঠান দশ, পনের কিংবা কুড়ি বছর পর এমপিও নামের সোনার হরিণের দেখা পেয়েছে-তাদের আনন্দ দেখে কে? মিষ্টি বিতরণ আর শোভাযাত্রায় এলাকা আনন্দের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। সে তো খুব স্বাভাবিক।

কিন্তু যারা এমপিওর মুখ দেখতে পায় নাই, তাদের মনের অবস্থা আজ কেমন? যারা এমপিওর জন্য আবেদন করেছিল, তারা সবাই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। অনেকে দশ, পনের কিংবা কুড়ি বছর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক সব কাজকর্ম চালিয়ে আসছে। কাম্য শিক্ষার্থী আছে। স্বীকৃতির বয়সও অনেক হয়েছে। দু'-একটা বিষয়ে হয়তো বা এক-আধটু ঘাটতি আছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হারে একটু ঊনিশ-বিশ থাকতে পারে। ঠুনকো অজুহাতে তারা এমপিও থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকলে সেটি দুঃখজনক। ননএমপিও শিক্ষক সংগঠনের অনেক নেতার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারে নাই। তাদের সভাপতি ও সচিবের প্রতিষ্ঠানও নাকি বাদ পড়েছে। উপযুক্ত কারণে তারা বাদ গিয়ে থাকলে কোন কথা নেই।  নন এমপিওদের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবার কারণে তাদের বাদ দেয়া হয়ে থাকলে, সেটি সত্যি কষ্টের বিষয়।

এবারের এমপিওভুক্তির বেলায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল বলে কোনও খবর অদ্যাবধি প্রকাশ হয়নি। তবে, অজ্ঞাত কিছু কারণে স্কুল গৃহ কিংবা শিক্ষার্থী নেই-এমন প্রতিষ্ঠান এমপিও কী করে বাগিয়ে নেয়? সরকারিকৃত প্রতিষ্ঠান এমপিওর তালিকায় স্থান পায় কী করে? পূর্বে এমপিও পাওয়া প্রতিষ্ঠান আবার নতুন করে এমপিও পায় কী করে? নতুন এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশিত হবার পর দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানী কয়েকটি প্রতিবেদনে এ জাতীয় অসঙ্গতি সারাদেশের মানুষ জানতে পেরেছে। এসব নিঃসন্দেহে এমপিও বঞ্চিতদের জন্য বটে, অন্য যে কোনো মানুষের জন্যও সত্যি দুঃখের কারণ।ভুল বা অযোহগ্য প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি করেছেন  সাবেক শিক্ষাসচিব ও শিক্ষা বিষয়ক দেশের েএকমাত্র জাতীয় পত্রিকা ধৈনিক শিক্ষার প্রধান উপদেষ্টা মো. নজরুল ইসলাম খান।  

আরেকটি বিষয় নিশ্চয় সবার দৃষ্টি গোচর হয়েছে। তা এই, এমপিওভুক্তির ঘোষণা আসার পর এমপিও পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে অনেকে ফেসবুক কিংবা অন্য সংবাদ মাধ্যমে স্থানীয় সংসদ সদস্য, কাছের কোনো মন্ত্রী মহোদয় ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকে উজাড় করে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে চলেছেন। তা থেকে কিছুটা অনুমেয় হয়, কিছু প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তিতে যোগ্যতার মাপকাঠির চেয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই বেশি ছিল। এর পেছনে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় এই যে, প্রভাবশালী মন্ত্রী মহোদয় কিংবা প্রভাবশালী এমপি মহোদয়রা এলাকায় অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠান এমপিও লাভে সক্ষম হয়েছে। আবার উল্টোটাও হতে পারে। স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীকে অভিন্দন না জানালে ‘বেয়াদবি’ হতে পারে! আবার এমনও খবর দেখলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত হয়নি। 

সদ্য এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের এমপিওভুক্তি নিয়ে পর্যালোচনা করলে এরকম নানা অসঙ্গতির বিষয় সহজে যে কারো চোখে ধরা পড়বেই। এতগুলো বছর পর এমপিওভুক্তির বেলায় এসব অসঙ্গতি কারো কাম্য ছিল না। আমরা তাই প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম যে, অন্তত যারাই স্বীকৃতি লাভ করেছে তাদের সকলকেই এমপিওভুক্ত করা হউক। ব্যাপক অর্থে 'স্বীকৃতি'-র মানে কী? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে 'স্বীকৃতি' বলতে কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা লাভের যোগ্যতা অর্জনের পর্যায়ে উন্নীত হবার সনদ দেয়াকে বুঝায়। দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদন মতে, গত সপ্তাহে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে ২২ জন ননএমপিও শিক্ষক নেতার বৈঠকে মন্ত্রী সাফ বলে দিয়েছেন স্বীকৃতি মানে কি। স্বীকৃতি মানে এক ধরনের লাইসেন্স। মানে প্রতিষ্ঠান চালানো বা শুরুর অনুমোদন। এর সাথে এমপিওভুক্ত করার কোনও সম্পর্ক নেই। 

 তবে আমাদের আর্থিক সঙ্গতি এখন প্রশ্নের ঊর্ধ্বে । সরকারের আয় উন্নতি বেড়েছে। কার সাহস এখন আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে?

এমপিওভুক্তির জন্য বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে এবার যতগুলো প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দেবার কথা, ততগুলো যোগ্য প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় নাই। চারশ কোটি টাকার উপরে উদ্বৃত্ত থেকে গেছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এমপিওভুক্তির বিষয়টিকে একটি চলমান প্রক্রিয়া বলেছেন। এ প্রক্রিয়া সারা বছর অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করতে পারি। কয়েক বছর জমিয়ে একবার এমপিও দেয়াতে যে অসঙ্গতি ধরা পড়ে, ফি বছর এমপিও দেয়া হলে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। প্রতি বছর যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিও দিয়ে দিলে যোগ্যতা অর্জনে দৃশ্যমান আরও প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। তাতে একদিকে লেখাপড়ার মান বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে শিক্ষায় গতি সঞ্চার হবে। ইদানিং এ দুটো ক্ষেত্রে আমরা বড় বেশি পিছিয়ে আছি। ফি বছর যোগ্যতা অর্জনকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তির দ্বার উন্মুক্ত রাখা দরকার। তা না হলে আমাদের শিক্ষার দৈন্যদশা কোনোদিন ঘুচবে না। বিশ্বের সাথে বাজি রেখে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে আমার প্রিয় স্বদেশ। শিক্ষার মন্থর গতির কারণে সে যাত্রায় ছেদ পড়ুক-সে আমাদের কারও কাম্য নয়।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027680397033691