এমপিও দুর্নীতি: সাতক্ষীরা সিটি কলেজে তদন্তে দুদক

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি |

নিয়ম বহির্ভূতভাবে এবং মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে রেজুলেশন জালিয়াতির মাধ্যমে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে ২০ জন শিক্ষক নিয়োগ ও ২১ জন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে । কলেজের সাবেক সভাপতি যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি জামায়াত নেতা খালেক ম-লের সময়ে নিয়োগ দেয়া ৬ জন জামায়াত কর্মীর নিয়োগের বৈধতা দেয়া হয়েছে বর্তমান সময়ে অভিযোগকারী এই বিষয়টিও তদন্তের দাবি করেছেন তার অভিযোগে। প্রায় ৪ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যে কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, কলেজ অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ও মাউশির মহাপরিচালক, মাউশির খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে এই অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে । অভিযোগকারী সিটি কলেজের সাবেক প্রভাষক বিধান চন্দ্র দাস দুদকে এই অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত পহেলা আগস্ট দুদকের উপ-পরিচালক এনফোর্সমেন্ট মোঃ মাসুদুর রহমান সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রতিবেদন প্রেরণ পূর্বক কমিশনকে অবহিত করণের নির্দেশ প্রদান করেছেন। 

সিটি কলেজের নিয়োগ বাণিজ্য ও নানা অনিয়মের অভিযোগ ও দুদকের তদন্ত বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজ অধ্যক্ষ মোঃ আবু সাঈদ সোমবার দুপুরে বলেন, অনিয়মের অভিযোগ সব মিথ্যা। অভিযোগকারী বর্তমানে আশাশুনি সরকারী কলেজে চাকরি করেন বলে তিনি জানান।

কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর মোসতাক আহমেদ রবির কাছে সিটি কলেজের দুদকের তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার দুপুরে তিনি বলেন, তদন্তের ব্যাপারে তার কিছু জানা নেই। তিনি বলেন, আমি নিয়মের বাইরে কিছু করিনি। এর বাইরে কিছু হয়ে থাকলে প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার দায়িত্ব অধ্যক্ষের। বিষয়গুলো অধ্যক্ষ ফেস করবে বলে তিনি জানান।

দুদকের ১০৬ হট লাইনে গত ২৪ জুলাই সাতক্ষীরা সিটি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক বিধান চন্দ্র দাস এক অভিযোগ দাখিল করেন। পরে এই অভিযোগের পক্ষে প্রমাণপত্রসহ লিখিত অভিযোগ চাওয়া হলে অভিযোগকারী প্রভাষক বিধান চন্দ্র দাস গত ৫ আগস্ট ৬ পৃষ্ঠা বর্ণিত অভিযোগ ও শতাধিক পৃষ্ঠার তথ্য প্রমাণসহ দুদক চেয়ারম্যান বরাবর ফের আবেদন করেন। যা হট লাইনে করা অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এদিকে অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত সিটি কলেজ ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে এমপিওভুক্ত হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মোঃ আবু সাঈদ সরকারী পরিপত্র উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে সিনিয়র শিক্ষককে হটিয়ে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। অভিযোগকারী গত ২ মে ২০১০ তারিখে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। উক্ত সময় তার ইনডেক্স ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী ইনডেক্স নাম্বার বা সরকারীকরণের জন্য অভিযোগকারী আবেদন করলেও অধ্যক্ষ সেটি ফরোয়ার্ড না করে ১২ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। অভিযোগকারী তা দিতে না পারায় প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ পরবর্তীতে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে গত ৫ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে অবৈধভাবে এবং জাল জালিয়াতির মাধ্যমে রুনা লায়লা নামক একজনকে পদায়ন করিয়াছেন। যা সম্পূর্ণ নীতি বহির্ভূত।

রুনা লায়লা গত পহেলা মে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ইনডেক্স নাম্বার পান। তার ইনডেক্স নাম্বার ৩০৯৪৩৬৪। কলেজ শিক্ষিকা রুনা লায়লা প্রাথমিক ও শিক্ষা অধিদফতর ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে সহকারী শিক্ষিকা পদে সরকারী চাকরি পান। এরপর পহেলা মার্চ ২০১৭ তারিখে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ অহিদুল আলম জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৪৩নং হেনচি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের অনুমতি প্রদান করেন। যথারীতি শিক্ষিকা রুনা লায়লা উক্ত স্কুলে যোগদান করে নিয়মিত চাকরি করেন এবং প্রত্যহ হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন এবং নিয়মিত বেতন ভাতা উত্তোলন করেন। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি গ্রহণের আগে তিনি সাতক্ষীরা সিটি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে ৪ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে যোগদান করে যথারীতি দায়িত্ব পালন ও কলেজ ফান্ড থেকে বেতন ভাতাদি উত্তোলন করেন। অভিযোগকারীর দাবি অবৈধ নিয়োগ সংক্রান্ত এবং জাল জালিয়াতি সংক্রান্ত সকল তথ্য অভিযোগকারীর নিকট রয়েছে।

অভিযোগ তৎকালীন পরিচালনা পরিষদের সভাপতি জামায়াত নেতা ও তৎকালীন সংসদ সদস্য বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ মামলায় কারাগারে থাকা অধ্যক্ষ মাও. আব্দুল খালেকের নির্দেশে এক বিতর্কিত নিয়োগ বোর্ড দেখিয়ে অধ্যক্ষ মোঃ ইমদাদুল হক, উপাধাক্ষ্য মোঃ শহিদুল ইসলাম, অর্থনীতি বিভাগে মোঃ কাদির উদ্দীন এবং মোঃ মফিজুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে একেএম ফজলুল হক, ইসলামের ইতিহাস বিভাগে মোঃ আশরাফুল ইসলাম ও মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ, ইতিহাস বিভাগে মোঃ জাকির হোসেন, দর্শন বিভাগের মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, ভূগোল বিভাগে মোঃ নজিবুল্যাকে রাতারাতি নিয়োগ প্রদান করেন। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ও ২৩ অক্টোবর শিক্ষা পরিদর্শক মোঃ মজিবুর রহমান এবং অডিট অফিসার মোঃ ফরিদ উদ্দীন নিরীক্ষা ও পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি দেয়া রিপোর্টে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুর রশিদের আমলে নিয়োগকৃত শিক্ষক কর্মচারীদের নিয়োগ যথাযথ হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগ, জামায়াত নেতা অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক ম-লের সময়ে বিতর্কিত ওই ১৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিল না করে বর্তমান অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি কাগজপত্র জালিয়াতি করে এবং প্রকৃত তথ্য গোপন করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অর্থনীতি বিভাগে মোঃ কাদির উদ্দীন এবং মোঃ মফিজুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে একেএম ফজলুল হক, ইসলামের ইতিহাস বিভাগে মোঃ আশরাফুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগে মোঃ জাকির হোসেন, দর্শন বিভাগের মোঃ জাহাঙ্গীর আলমকে এমপিওভুক্ত করান। অভিযোগ রয়েছে এরা সকলেই জামায়াত শিবিরের ক্যাডার এবং বিভিন্ন নাশকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় একাধিকবার আটক হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের এমপিও হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ, সিটি কলেজের প্রভাষক অরুণ কুমার ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর উক্ত কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শাখায় যোগদান করেন। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগস্ট ও ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ মার্চ পরিপত্রে ডিগ্রী স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্তির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এই প্রজ্ঞাপন উপেক্ষা করে অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ও কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির যোগসাজশে ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক অরুণ কুমার সরকারের নিয়োগ ও যোগদান সংক্রান্ত তথ্য জালিয়াতি ও গোপন করে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখের পূর্বে ডিগ্রী স্তরের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে এমপিওভুক্ত করেন। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র উপেক্ষা করে ডিগ্রী স্তরে ইংরেজী বিভাগে এসএম আবু রায়হান, বাংলা বিভাগে মোঃ মনিরুল ইসলাম, দর্শন বিভাগে মোঃ নাসির উদ্দীনকে একইভাবে জালজালিয়াতির মাধ্যমে ও তথ্য গোপন করে ডিগ্রী স্তরের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। বিএসসি শাখায় ডিগ্রী স্তরে কোন ছাত্র ছাত্রী না থাকলেও প্রাণী বিজ্ঞানে আশরাফুন্নাহার ও সুরাইয়া জাহানকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের কাগজপত্র জালিয়াতি করে ও তথ্য গোপন করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদকের প্রধান কার্যালয়ের হট লাইনে ২৭ জুলাই ও লিখিত অভিযোগ প্রাপ্তির পর গত পহেলা আগস্ট দুদকের উপ-পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মোঃ মাসুদুর রহমান ইনফোর্সমেন্ট ইউনিটের নথি নং ই.এন/প্রকা/৭৮৯ স্মারকে গৃহীত অভিযোগটির বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে প্রেরণ করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে। সেখানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক প্রতিবেদনের মাধ্যমে কমিশনকে অবহিতকরণের জন্য বলা হয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের - dainik shiksha হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস - dainik shiksha নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর - dainik shiksha অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068531036376953