এমপিও সফটওয়্যার জটিলতা : যোগদানে ভোগান্তি ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের

রুম্মান তূর্য |

বদলির ব্যবস্থা না থাকায় এমপিও নীতিমালার একটি বিধান অনুসারে আবেদন করে কয়েকহাজার এমপিওভুক্ত বা ইনডেক্সধারী শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও মাদরাসায়। কিন্তু নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের আগে অভিজ্ঞতা ও ইনক্রিমেন্ট বহাল না থাকা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা। স্কুলে এমপিওভুক্ত হওয়া শিক্ষকরা মাদরাসায় যোগদান ও মাদরাসায় আগের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা স্কুল বা কলেজে যোগদান নিয়ে শঙ্কায় আছেন। এমপিও নীতিমালা অনুসারে সমপদে ও সমস্কেলে নিয়োগ পেলে অভিজ্ঞতা বহাল থাকার কথা থাকলেও এ বিধানের কার্যকারিতা না থাকায় তারা অভিজ্ঞতা ও অর্জিত ইনক্রিমেন্ট বহাল থাকা নিয়ে শঙ্কিত। কারণ স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের এমপিও প্রক্রিয়ার সফটওয়্যার ও মাদারাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও প্রক্রিয়ার সফটওয়্যারের মধ্যে সমন্বয় নেই। তাই এমপিও নীতিমালায় সমপদের নিয়োগের পর আগের পদের অভিজ্ঞতা বা ইতোমধ্যে অর্জিত ইনক্রিমেন্ট গণনা হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। এ জটিলতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় স্কুল থেকে মাদরাসায় ও মাদরাসা থেকে স্কুলে নতুন নিয়োগ সুপারিশ পাওয়া হাজারও ইনডেক্সধারী শিক্ষকের ঘুম হারাম হয়েছে।

  

দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নজরে আনা হলে তিনি ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের এ জটিলতা নিরসনের আশ্বাস দিয়েছেন। সার্বিকভাবে সব বিধিবিধান পর্যালোচনা করে এ জটিলতা নিরসনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।

গতমাসে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলের (সহকারি শিক্ষক, প্রভাষক) শিক্ষক পদে ৩৪ হাজার প্রার্থীকে চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়েছে। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির আলোকে তারা শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন।  

এমপিও প্রক্রিয়াকরণ সফটওয়্যারে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পরিচিতি নম্বরকেই ইনডেক্স বলা হয়। ইনডেক্সধারী শিক্ষক বলতে বোঝায় ইতোমধ্যে এমপিওভুক্ত হওয়া শিক্ষক যাঁর ইতোমধ্যে পরিচিতি নম্বর আছে।

বেসরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের বদলির ব্যবস্থা এখনো নেই। ২০১৮ ও ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে জারি হওয়া এমপিও নীতিমালায় বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির জন্য আলাদা নীতিমালা জারির কথা থাকলেও সে বিষয়ে এখনো কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নিজ বাড়ি থেকে দূরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এমপিওভুক্ত বা ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের জন্য নতুন প্রতিষ্ঠানে নতুন করে নিয়োগ পাওয়ার বিধান রাখা হয়েছে এমপিও নীতিমালায়। সে অনুসারে ইনডেক্সধারী বা এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সমপদে বা সমস্কেলের পদে নিয়োগের আবেদন করতে পারেন। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে এমপিও নীতিমালার এ বিধান অনুসারে আবেদন করা হাজার হাজার শিক্ষকের নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ করে এনটিআরসিএ।

    

নতুন সুপারিশ পাওয়া শিক্ষকরা বলছেন, তারা আগের ইনডেক্স নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে ভয় পাচ্ছেন। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে দাখিল মাদরাসায় সুপারিশ পাওয়া ইনডেক্সধারী বা এমপিওভুক্ত শিক্ষক মো. আবদুর রহমান দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, মাদরাসা অধিদপ্তরের এমপিওর সফটওয়্যার মেমিসে এমপিওভুক্ত হতে স্কুল থেকে মাদরাসায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের নতুন করে অনলাইনে আবেদন করতে হবে। কিন্তু ওই সফটওয়্যারে স্কুলের চাকরিকালের অভিজ্ঞতা অনুসারে অর্জিত ইনক্রিমেন্ট বহাল থাকবে না। তাই মাদরাসাটি বাড়ির কাছে হলেও যোগদান করবো কি-না না বুঝতে পারছি না। কারণ ইনক্রিমেন্ট ও অভিজ্ঞতা যুক্ত হবে না। 

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হুদা পুটিয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষক মো. কাশেম আলী একটি মাদরাসায় নতুন করে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন। এ শিক্ষক দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, নতুন সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অর্ধেকের বেশি প্রার্থীই ইনডেক্সধারী শিক্ষক। এই বিরাট সংখ্যক শিক্ষকদের অনেকে মাদরাসা বা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্কুল কলেজ ও স্কুল কলেজ থেকে মাদরাসা বা কারিগরি প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পেয়েছেন। অনেক ইনডেক্সধারী শিক্ষক ইতোমধ্যে কয়েকটি ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন। মাদরাসা থেকে স্কুলে নিয়োগ পেয়ে তাদের নতুন করে এমপিওভুক্তির আবেদন করতে হবে। কারণ স্কুল কলেজ ও মাদরাসার এমপিও প্রক্রিয়াকরণ সফটওয়্যার আলাদা। মাদরাসায় নিয়োগ পেয়ে এমপিওভুক্ত হলে স্কুলের ইনক্রিমেন্ট বা অভিজ্ঞতা যোগ হবে না। তাই আমরা ভোগান্তিতে আছি। ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদান নিয়ে ভয়ে আছেন। 

তিনি আরও বলেন, এ সমস্যাটি এখনই স্থায়ীভাবে সমাধান করা প্রয়োজন। তা না হলে প্রতিটি নিয়োগ চক্রে সুপারিশপ্রাপ্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা আর্থিক ক্ষতি, ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হবেন।

মাদরাসা থেকে স্কুলে নিয়োগ সুপারিশ পাওয়া এবং স্কুল থেকে মাদরাসায় নিয়োগ সুপারিশ পাওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষক দৈনিক আমাদের বার্তাকে একই কথা জানিয়েছেন।  

২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে জারি হওয়া স্কুল-কলেজের এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোর ১১.১৫ ধারায় বলা হয়েছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইনডেক্সধারী শিক্ষক ও প্রদর্শক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমপদে বা সমস্কেলের চাকরিতে যোগদান করলে আগের অভিজ্ঞতা গণনাযোগ্য হবে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে জারি হওয়া মাদরাসার সংশোধিত এমপিও নীতিমালার ১১.৮ ধারায়ও একই কথা বলা হয়েছে।  

কিন্তু আলাদা আলাদা দুইটি এমপিও নীতিমালায় একই বিধান থাকলেও তার কার্যকারিতা নেই বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। 

জটিলতা যেখানে :

দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের এমপিও প্রক্রিয়ার করা হয় ইমআইএস সফটওয়্যারে। আর মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর মাদরাসার শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিও প্রক্রিয়া করে মেমিস সফটওয়্যারের মাধ্যমে। আলাদা দুটি এমপিও সফটওয়্যারের মাধ্যমে দুই ধরণের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এমপিও প্রক্রিয়া করায় এক সফটওয়্যার থেকে অন্য সফটওয়্যারে তাদের অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার উপপরিচালক  মো. সাইফুল ইসলাম দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, স্কুল কলেজের শিক্ষকদের ইএমআইএস সফটওয়্যার থেকে মেমিস আলাদা। তাই ওই সফটওয়্যার থেকে মেমিসে ইনডেক্স ট্রান্সফার করা যায় না। স্কুল থেকে কোনো শিক্ষক মাদরাসায় সুপারিশ পেলে তাকে নতুন করে এমপিওভুক্তির আবেদন করতে হয়। এতে তার আগের অভিজ্ঞতা যুক্ত করা যায় না। 

এমপিও নীতিমালায় অভিজ্ঞতা গণনার বিধান আছে জানালে তিনি বলেন, এ বিষয়টি শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের নজরে আনলে বিষয়টি সমাধান হতে পারে। 

এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ইএমআইএস সেলের কর্মকর্তারা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, মেমিসের সঙ্গে ইএমআইএসের এপিআই বা অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস নেই। তাই মাদরাসার শিক্ষকরা স্কুলে নতুন নিয়োগ পেলে তাদের আবারও এমপিওভুক্তির আবেদন করতে হচ্ছে। এপিআই থাকলে এ জটিলতা হতো না। তাহলে তাদের ইনডেক্স থেকে তথ্য নিয়ে আমরা তাদের ইনডেক্স ইএমআইএস সেলে নিয়ে আসা যেত। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. এনামুল হক হাওলাদার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এমপিও নীতিমালায় সমপদের ও সমস্কেলে যোগদান করলে তাদের অভিজ্ঞতা গণনা হওয়ার বিধান আছে। কিন্তু টেকনিক্যাল কারণে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। 

সমস্যার সমাধান হতে পারে যেভাবে :

মেমিসের সঙ্গে ইএমআইএস সফটওয়্যারের এপিআই বা অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেসের ব্যবস্থা করলে জটিলতা নিরসন সম্ভব বলে মত দিয়েছেন ইএমআইএস সেলের কর্মকর্তারা। অনেকে অফলাইনে ম্যানুয়ালি তথ্য অন্তর্ভুক্তির কথাও বলছেন। তবে,ম্যানুয়ালি তথ্য অন্তর্ভুক্তিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 

এদিকে ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে তাদের জটিলতা নিরসনের দাবি জানিয়েছেন। তারা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের পরও তাদের অর্জিত ইনক্রিমেন্ট বহাল রাখার দাবি জানিয়েছেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052690505981445