এ কে ফজলুল হক: এক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও জননেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের আজ জন্মদিন। তিনি কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদসহ বহু উঁচু রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ‘শেরে বাংলা’ বা হক সাহেব নামে পরিচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক বাকেরগঞ্জ জেলার দক্ষিণাঞ্চলের বর্ধিষ্ণু গ্রাম সাটুরিয়ায় ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিলো বরিশাল শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে চাখার গ্রামে। তিনি ছিলেন মুহম্মদ ওয়াজিদ ও সায়িদুন্নিসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। তার পিতা বরিশাল আদালতের দেওয়ানি ও ফৌজদারি উকিল ছিলেন এবং তার পিতামহ কাজী আকরাম আলী ছিলেন আরবি ও ফারসিতে দক্ষ পণ্ডিত ও বরিশালের একজন বিশিষ্ট মোক্তার। বাড়িতে আরবি ও ফারসিতে সনাতন ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে ফজলুল হক বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পরীক্ষায় (রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ) উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ল কলেজ’ থেকে বিএল ডিগ্রি লাভ করে ফজলুল হক স্যার আশুতোষ মুখার্জীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। বহুরূপে ও বিভিন্নভাবে  অশ্বিনীকুমার দত্ত এবং  প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর স্নেহলাভের সৌভাগ্য হয়েছিলো তার। পিতার মৃত্যুর পর হক বরিশাল শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সময়ে তিনি এ শহরের রাজচন্দ্র কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার। সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি জনসেবামূলক কাজ ও আইন ব্যবসাকে বেছে নেন। স্যার আশুতোষ মুখার্জীর পরামর্শে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

স্যার  খাজা সলিমুল্লাহ ও নওয়াব  নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয়। তাদের সহযোগিতায় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে পরাজিত করে ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মাঝখানে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে দুবছর (১৯৩৪-১৯৩৬) ছাড়া ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগ পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় আইন সভার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক হন এবং ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। সর্বভারতীয়  মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হয়ে তিনি সে সংগঠনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষ্মৌ চুক্তি প্রণয়নে সহায়কদের অন্যতম। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯১৮-১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দি ফজলুল হক সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের দিল্লি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ফজলুল হক জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য মতিলাল নেহরু,  চিত্তরঞ্জন দাস ও অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের নিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক গঠিত পাঞ্জাব তদন্ত কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা প্রাদেশিক সম্মেলনের মেদিনীপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের পর আইন সভায় কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করায় একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। কংগ্রেস কোয়ালিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ৩৫ জন সদস্যের কেপিপি সংসদীয় দলের নেতা একে ফজলুল হক মুসলিম লীগ ও অন্য কয়েকটি সংখ্যালঘু ও তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত গোষ্ঠীকে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তার সঙ্গে যোগদানে রাজি করাতে সফল হন। কোয়ালিশন দলের নেতারূপে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল ফজলুল হক বাংলা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন। গভর্নর স্যার অ্যান্ডারসন যে মন্ত্রিসভা নিয়োগ করেন তাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক। 

যে মন্ত্রিসভা প্রদেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করে তা ছিলো বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মিশ্রণ, যাদের আদর্শগত অবস্থান ছিলো ভিন্ন। ফজলুল হকের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলেই এ ঐক্য সম্ভব হয়েছিলো, কেনোনা তিনি ছিলেন উভয় সম্প্রদায়েরই আস্থাভাজন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই কোয়ালিশনে দলগত বিতর্ক ও কলহ শুরু হয় এবং অনেকেই দলত্যাগ করেন। অংশত এটা ঘটেছিল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আনুগত্য পরিবর্তন, ব্রিটিশ রাজকীয় স্বার্থের পারস্পরিক ক্রিয়া, শাসনতন্ত্রকে কার্যকর করতে কংগ্রেসের অনমনীয়তা এবং প্রদেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ লাভে লীগের দৃঢ় সংকল্পের কারণে। 

কোয়ালিশনের দুটি বড় শরিক দল লীগ ও কৃষক পার্টির মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবে এবং লীগের ও অন্যান্য বিচ্ছিন্ন দলগোষ্ঠীর ভূমি ও বাণিজ্যে কায়েমি স্বার্থ থাকায় নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় প্রতিশ্রুত সংস্কারের বাস্তবায়নের জন্য প্রজা পার্টির প্রগতিবাদীরা চাপ দিলে হক মন্ত্রিসভা শুরু থেকেই দলাদলির শিকার হয়ে পড়ে। গভর্নর তার বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্ত ও কারারুদ্ধ হওয়ার কারণে মন্ত্রিসভায় প্রজা পার্টির সম্পাদক শামসুদ্দীনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলে কোয়ালিশন দলের সাধারণ স্তরের কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষের প্রথম চিহ্ন দেখা দেয়। গভর্নর মন্ত্রিসভায় প্রজা পার্টির অন্য একজন প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তিরও বিরোধিতা করেছিলেন। এ অবস্থায় মন্ত্রিসভায় হকের পক্ষে নিজের অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি নিজে এবং নওশের আলী ছাড়া মন্ত্রিসভার অন্য সব মুসলিম সদস্যই ছিলেন মুসলিম লীগের। এটা প্রজা পার্টির প্রগতিবাদী কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুলাই অনুষ্ঠিত প্রথম বাজেট অধিবেশনে ভোটগ্রহণের সময় পার্টির বেশ কয়েকজন সদস্য শামসুদ্দীনের নেতৃত্বে কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিলে প্রজা পার্টির অভ্যন্তরীণ ধূমায়িত উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করে। কিছুদিন পর ফজলুল হক কর্তৃক নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গের অজুহাতে প্রজা পার্টির প্রগতিবাদী ২১ জন সদস্য কোয়ালিশন ত্যাগ করেন। দলত্যাগের এ নাটকে লীগ সুবিধা লাভ করে এবং আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সমর্থনের জন্য তিনি লীগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। লীগের প্ররোচনায় হক দলত্যাগীদের ইসলামের স্বার্থের বিরোধী বলে ঘোষণা করেন।

বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে তিনি কিছু যুক্তিসংগত শর্তে জোট গঠনের প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেসের দ্বারস্থ হন। কিন্তু কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখাত হলে হক মুসলিম লীগের আরো বেশি নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ অক্টোবর লক্ষ্ণৌতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগের মতবাদ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলার কোয়ালিশনের সব মুসলিম সদস্যকে লীগে যোগদানের এবং লীগের পতাকাতলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। প্রকাশ্যে প্রজাপার্টির সঙ্গে তিনি তার সম্পর্ক ছেদ না করলেও তার নেতৃত্ব ছাড়া বস্ত্তত পার্টি মর্যাদা হারিয়ে ফেলে এবং জনসাধারণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তাও হ্রাস পেতে শুরু করে।

দুটি উপদলের পক্ষত্যাগের ফলে কোয়ালিশনের ওপর হকের নিয়ন্ত্রণ আরো দ্রুত শিথিল হতে থাকে। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ তমিজউদ্দীন খানের নেতৃত্বে প্রজা পার্টির ১৩ সদস্যের একটি দলছুট গোষ্ঠী কোয়ালিশনের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত না করায় তমিজউদ্দীন খান হকের প্রতি বিরূপভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি প্রস্তাবিত ভূমি-রাজস্ব কমিশনের কর্মপরিধি সম্পর্কে আপত্তিকে তার সমর্থন প্রত্যাহারের কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। গান্ধী ও  শরৎ বসুর প্ররোচনায় তফসিলি সম্প্রদায়ের ১৫ জন সদস্য সরকারি দল ত্যাগ করলে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মার্চ আরেকটি দলত্যাগের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ দলত্যাগের ঘটনার পর মন্ত্রিসভা আরো বেশি মুসলিম মন্ত্রিসভার চরিত্র পরিগ্রহ করে এবং একতরফাভাবে শুধু মুসলিম স্বার্থের প্রবক্তারূপে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন মন্ত্রী এবং আইনসভায় প্রজা পার্টির উপনেতা নওশের আলী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ না করেও কোয়ালিশনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে লীগের ওপর তার নির্ভরশীলতা আরো বেড়ে যায়। কোয়ালিশনের প্রতি তার সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় নওশের আলী প্রকাশ করেন, মন্ত্রিসভার রক্ষণশীল সদস্যরা কায়েমি স্বার্থবাদীদের সহযোগিতায় বাংলার কৃষকদের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। তার অভিযোগের পরপরই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আদান-প্রদানকৃত ব্যক্তিগত পত্রাবলির বেশ কয়েকটি একতরফাভাবে প্রকাশ করেন। কালক্রমে প্রজা পার্টির অবক্ষয় ঘটলে লীগের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না এবং মন্ত্রিসভার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু আর্থ-সামাজিক সংস্কার থেকে সরে গিয়ে সাম্প্রদায়িক বিষয়ে নিবদ্ধ হয়। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কংগ্রেস-প্রস্তাবিত বেশ কয়েকটি অনাস্থা প্রস্তাব আইনসভায় পেশ করা হয়। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর শামসুদ্দীন ও তমিজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভায় যোগদানে রাজি করাতে সক্ষম হন। শামসুদ্দীন অবশ্য অতিরক্ষণশীল সদস্যে পূর্ণ মন্ত্রিসভায় দলগত সদস্য হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। অচিরেই তাকে আবার সংকটময় অবস্থায় ফেলে তমিজউদ্দীন মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

দুঃসাধ্য হলেও এ পর্যন্ত ফজলুল হক তার মন্ত্রিসভার বিরোধী পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন; কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তিনি এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে জিন্নাহর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফজলুল হক ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করলে জিন্নাহ্ তাকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে এবং কোয়ালিশন দল থেকে লীগকে প্রত্যাহার করে এর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ নাটকীয় পরিস্থিতি অবশ্য হককে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে নতুনভাবে রাজনৈতিক মৈত্রী গঠনের এক অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছিলো।

মুসলমান সম্প্রদায়ের পশ্চাৎপদতা দূর করার উদ্দেশে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী রূপে তিনি মুসলমানদের জন্য চাকরির ৫০ শতাংশ সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ দান করেন এবং বাংলা সরকারের অফিসগুলোতে এ অনুপাত কঠোরভাবে কার্যকর করেন। সরকার এ নীতি মেনে নেয় যে, যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া গেলে সরাসরিভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ চাকরি তফসিলী সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত রাখা হবে, তবে এ সংরক্ষণ সরাসরিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত অমুসলমানদের ৩০ শতাংশের বেশি হবে না। তার প্রথম মন্ত্রিত্বের সময়ে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের গতি ত্বরান্তিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য প্রদেশে বসবাসকারি সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই শিক্ষার বিস্তার করাকে তিনি তার দায়িত্বরূপে বিবেচনা করেছিলেন। এ লক্ষ্য নিয়ে তিনি বঙ্গীয় আইন সভায় ‘প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ পেশ করেন যা প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করে আইন হিসেবে পাস করা হয়েছিলো। কিন্তু ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন সভায় ‘মাধ্যমিক শিক্ষা বিল’ পেশ করলে এতে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি সংযুক্ত থাকায় বিরোধী দলীয় সদস্যদের মধ্যে ও সংবাদপত্রগুলিতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তিনি ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) কলকাতা, লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ, ওয়াজিদ মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল এবং চাখার কলেজের মতো বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ-বিভক্তির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি লক্ষ্য করে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে ফজলুল হক আহত হন। তিনি মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতারূপে আবির্ভুত হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি  ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গণ অভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকে এক নতুন দিকনির্দেশনা দান করে। 

পাকিস্তানে সদ্য গঠিত গণ-পরিষদে হকের যথেষ্ট সমর্থক ছিলেন। তারা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করতেন যার ফলে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে হককে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন এবং ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সেই পদ থেকে অপসারিত হন। তারপর থেকেই তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। কাজী নজরুল ইসলাম এভেনিউর দক্ষিণপ্রান্তে শিশু একাডেমির পশ্চিম পাশে তিন নেতার মাজারের মধ্যে একটি হলো তার সমাধি।

প্রায় অর্ধশতক ধরে ফজলুল হক ছিলেন উপমহাদেশের এক বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ বাগ্মী। ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে তিনি অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। একই সাথে ইসলামি, বাঙালি ও ভারতীয় পরিচয় তার মানসকে প্রভাবিত করায় তার চিন্তা ও কর্মে পরস্পরবিরোধী উপাদান প্রকাশ পায়। পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নয়নের কথা তাকে ভাবতে হতো, সমগ্র বাঙালি জাতির অগ্রগতির চিন্তায় তিনি ছিলেন মগ্ন এবং একইসঙ্গে যুক্ত স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন তিনি সযত্নে লালন করতেন। স্বাভাবিকভাবেই তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি সংগতিপূর্ণ নীতি অনুসরণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। 

ব্যক্তিগত ও জনজীবনে হক ছিলেন অত্যন্ত সরল। তার জীবদ্দশায়ই জাতিধর্ম নির্বিশেষে জনসাধারণ তার উদার ও পরোপকারী স্বভাবের জন্য তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। দুর্দশাগ্রস্ত ও অতি দরিদ্রদের সাহায্য করতে গিয়ে তিনি নিজেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বাংলার মানুষ হককে তার চাতুর্য বা তাঁর অস্থির রাজনৈতিক আচরণের জন্য স্মরণ করে না, তারা তাকে স্মরণ করে পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধনের জন্য তার আন্তরিক প্রচেষ্টা, বিপুল সংখ্যক কৃষকের দারিদ্র্য বিমোচন ও তার উদার প্রকৃতির জন্য।

সূত্র : বাংলাপিডিয়া

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অবশেষে বাজারে আসছে একাদশ শ্রেণির পাঁচ আবশ্যিক বই - dainik shiksha অবশেষে বাজারে আসছে একাদশ শ্রেণির পাঁচ আবশ্যিক বই অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে রেলগেট অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে রেলগেট অবরোধ তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে - dainik shiksha আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে - dainik shiksha ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি - dainik shiksha কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026099681854248