ওমেগা, অর্গানিক ডিমের নামে প্রতারণা

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

বাহারি নামের মোড়কে ডিমে বিশেষ পুষ্টিমান যোগ করার কথা লিখে ভোক্তাদের পকেট কাটছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। প্যাকেট বা মোড়কের গায়ে অর্গানিক ডিম, ভিটামিন ই সমৃদ্ধ ডিম ইত্যাদি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করে কোম্পানিগুলো প্রতিটি ডিমে দাম বেশি রাখছে ৩ থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তবে সেই বিশেষ পুষ্টি ডিমে যোগ করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

বাজারে দুই ধরনের ডিম পাওয়া যায়–প্যাকেটজাত ও খোলা। প্যাকেটজাত ডিম বাজারজাত করা হচ্ছে ওমেগা-৩, অর্গানিক, ভিটামিন ই, ব্রাউন, ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ ইত্যাদি নামে । এসব প্যাকেটজাত ডিমে কী পরিমাণ বিশেষ উপাদান আছে, সে বিষয়ে কোনো প্রমাণপত্র তেমন কারও কাছে নেই। দু-একটি কোম্পানি বিভিন্ন সময়ে গবেষণাগারে ডিম পরীক্ষা করালেও ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের পর আর কেউই পরীক্ষা করায়নি।

  

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিশেষ পুষ্টিসমৃদ্ধ দাবি করা ডিম শুধু সুপারশপগুলোতেই নয়, সাধারণ দোকানেও কমবেশি পাওয়া যাচ্ছে। খোলা অবস্থায় প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ১৩ থেকে ১৩ টাকা ৫০ পয়সায়, আর মোড়কজাত ডিমের দাম ১৫ টাকা ৮৩ পয়সা থেকে ২২ টাকা ৮ পয়সা। অর্থাৎ মোড়কজাত প্রতিটি ডিমে বেশি রাখা হচ্ছে ২ টাকা ৮৩ পয়সা থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত। তবে এসব ডিমে কী পরিমাণ বিশেষ উপাদান থাকছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই উৎপাদনকারীদের কাছেও।

জানা গেছে, রেনাটা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, প্যারাগন অ্যাগ্রো লিমিটেড, কাজী ফার্মস কিচেন, কোয়ালিটি ইন্টিগ্রেটেড অ্যাগ্রো লিমিটেড, কান্ট্রি ন্যাচারালসহ বিভিন্ন কোম্পানির নামে বাজারজাত করা হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সম্প্রতি রাজধানীর তিনটি সুপারশপে অভিযান চালিয়ে দেখতে পায়, প্রতিটি সাধারণ ডিম ও বিশেষ ডিম ৭ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছিল। বিশেষ ডিমে কী ধরনের উপাদান আছে বা কেন বিশেষ; সে-সংক্রান্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ তাৎক্ষণিকভাবে কেউ দিতে পারেননি। প্যারাগন ও রেনাটা লিমিটেডের অফিসে অভিযান চালিয়েও এ-সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরে ২ জুন তাদের তথ্য-প্রমাণসহ অধিদপ্তরে ডাকা হয়। সেখানে রেনাটার পক্ষ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ডিম পরীক্ষার কিছু কাগজ দাখিল করা হলেও প্যারাগন অ্যাগ্রো লিমিটেড কিছুই দেখাতে পারেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, বাজারে বিক্রি হওয়া সাধারণ ও ভিটামিনসমৃদ্ধ ডিমের মধ্যে আদৌ কোনো তফাত আছে কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিম পরীক্ষা করাতে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে অধিদপ্তরের একজন পরিচালককে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়েছে। কমিটিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্যারিফ কমিশন, বিএসটিআই, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ক্যাব, সুপারশপ প্রতিনিধি ও কোম্পানির প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে দৈনিক ডিম উৎপাদিত হয় ৬ কোটি ৪০ লাখ। চাহিদা ৫ কোটি ১০ লাখ। ১ শতাংশ ‘অর্গানিক’ ডিম উৎপাদিত হলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ লাখ ৫০ হাজার।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিদের একটি ডিম উৎপাদন করতে খরচ হয় ১০ টাকা ২৯ পয়সা। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ পড়ে ডিমপ্রতি ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। প্রতিটি ডিম উৎপাদক বিক্রি করেন ১১ টাকায়। স্থানীয় ব্যবসায়ী ডিমপ্রতি মুনাফা করেন ১০ পয়সা। শহরের আড়তদার মুনাফা করেন ৪০ পয়সা। ভ্যান গাড়িতে করে যাঁরা বেচেন, তাঁদের মুনাফা ৩৫ পয়সা। খুচরা বিক্রেতার মুনাফা ৬৫ পয়সা। সব মিলিয়ে খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের যৌক্তিক দাম ১২ টাকা ৫০ পয়সা।

ডিমের বিশেষ গুণ ও বাড়তি দাম সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘মুরগিকে ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ালে ডিমে তা পাওয়া যাবে। তবে এসব ভ্যালু অ্যাডেড ডিম বাজারজাত করার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার। একই সঙ্গে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের সার্টিফিকেট ছাড়া বাজারজাত করার কোনো সুযোগ নেই। ভ্যালু অ্যাডেড থাকার বিষয়টি কোন সংস্থা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করেছে, সেটিও দেখতে হবে।’

প্যারাগন অ্যাগ্রো লিমিটেডের ডিমের প্যাকেটে লেখা আছে, উন্নত মানের খাদ্য দেওয়া হয়, ডিম খাঁটি ও প্রিজারভেটিভ মুক্ত। ওই ডিম সম্পর্কে ফোনে জানতে চাইলে প্যারাগন অ্যাগ্রোর সহকারী ব্যবস্থাপক আলী হায়দার অফিসে যেতে বলেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মহাখালীতে কোম্পানির অফিসে গেলে অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা কর্মী ইন্টারকমে কথা বলে জানান, আলী হায়দার মিটিংয়ে আছেন। পরে কথা বলবেন।

রাজধানীর আজিমপুর এলাকার সরকারি চাকরিজীবী সুমন কুমার দাস বলেন, তিনি নিয়মিত ওমেগা-৩ ডিম কিনছেন। তবে সাধারণ ডিমের সঙ্গে এর কোনো তফাত খুঁজে পাননি। তবে আল-আমীন নামের এক কর্মচারী বলেন, বিশেষ ডিমের কুসুম লাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, তিনি ওই ডিমে তেতো স্বাদ পান। পরে তা দোকানিকে ফেরত দেন।

মহাখালী কাঁচাবাজারের সাধারণ ডিম বিক্রেতা আলী মিয়া বলেন, প্যাকেটের ডিমে মুরগিকে গাজর খাওয়ানো হয়। এ ছাড়া নানা ধরনের ভিটামিন দেওয়া হয় বলে কোম্পানির লোকজন তাঁদের কাছে প্রচার করেন।

তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি আমানত উল্লাহ বলেন, ডিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাড়তি দাম নেওয়া কোম্পানির একধরনের প্রতারণা।

রেনাটা অ্যাগ্রোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা ডিম পরীক্ষা করানোর কয়েকটি সনদ দেখান। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল ও ৬ জুন ডিমের ওমেগা-৩সহ তিনটি অ্যাসিড পরীক্ষা করানো হয়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও রেনাটার নিজস্ব ল্যাবেও পরীক্ষা করানো হয়েছে।

রেনাটা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক খালিদ দীন আহমেদ বলেন, একটি ওমেগা-৩ ডিম তৈরি করতে ১৮ টাকা ৪০ পয়সা খরচ হয়। দোকানিদের কমিশন ১৫-১৭ শতাংশ, প্যাকেজিং ও লেবেলিং ১২ টাকা। ২ শতাংশ ভেঙে যায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন মিলিয়ে প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১৮ টাকা ৪০ পয়সা ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁদের ডিমে ২০০ মিলিগ্রাম ওমেগা-৩, কমপক্ষে ৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই এবং ৭৫ মাইক্রোগ্রাম ফলিক অ্যাসিড আছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, সাধারণ খামারিরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা বা তৈরি করা খাবারই ব্যবহার করছেন। সব নিয়মকানুন মেনেই ডিম তৈরি ও বাজারজাত করা হচ্ছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে বিশেষ ডিমের প্রচার চালানোয় সাধারণ খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের যুগ্ম প্রধান মাহমুদুল হাসান বলেন, প্রকৃত অর্গানিক ডিম হলে তার দাম সাধারণ ডিমের চেয়ে বেশি হবে। তবে এগুলো অর্গানিক কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ ডিমেও কমপক্ষে ৯০ মিলিগ্রাম ওমেগা-৩ আছে। তাহলে ওমেগা-৩ ডিমে কত মিলিগ্রাম ওমেগা-৩ রয়েছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। একই সঙ্গে অন্যান্য উপাদানের তথ্যও থাকতে হবে।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপপরিচালক (মান) এনামুল হক বলেন, সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত জাতের মুরগি, খামারের নিরাপদ ফিড বা খাবার, খামারের পরিবেশ, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে পুষ্টিসমৃদ্ধ ডিম উৎপাদন। এর বাইরে খোসাসহ ডিমে ভ্যালু অ্যাড করার অন্য কোনো সুযোগ নেই। স্বাভাবিক পরিচর্যায় উৎপাদিত ডিমের অতিরঞ্জিত গুণাগুণ বর্ণনা করা মিথ্যাচারের পর্যায়ভুক্ত।

ভ্যালু অ্যাডেড ডিম বাজারজাত করার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার। একই সঙ্গে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের সার্টিফিকেট ছাড়া বাজারজাত করার কোনো সুযোগ নেই।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের - dainik shiksha গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস - dainik shiksha শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম - dainik shiksha মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে অধ্যাপকদের অনলাইনে বদলির আবেদন শুরু ১ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha অধ্যাপকদের অনলাইনে বদলির আবেদন শুরু ১ সেপ্টেম্বর সব মাদরাসায় ওয়েবসাইট হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসায় ওয়েবসাইট হালনাগাদের নির্দেশ ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত শিক্ষাঙ্গনের ভদ্রতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষাঙ্গনের ভদ্রতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043580532073975