খোদ অধ্যক্ষের নির্দেশে ফেনীর ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাসহ মাদ্রাসায় একের পর এক ছাত্রীদের যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে নড়েচড়ে বসেছে শিক্ষা প্রশাসন। মেয়েদের নিরাপত্তায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে সরকার নিয়ন্ত্রিত ও অধিভুক্ত সকল মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায়। দেশের প্রতিটি মাদ্রাসায় মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশনা পাঠিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। ছাত্রীদের নিরাপত্তায় প্রত্যেক মাদ্রাসায় একজন করে নারী মেন্টর নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যার নেতৃত্বে কাজ করবে পাঁচ সদস্যের কমিটি। এখন থেকে অধ্যক্ষসহ কোন পুরুষ শিক্ষক কোন ছাত্রীকে সরাসরি ডাকতে পারবেন না। প্রয়োজনে মেন্টর ও কমিটির মাধ্যমে ডাকতে হবে। মঙ্গলবার (০২ জুলাই) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিভাষ বাড়ৈ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাদ্রাসায় শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, মাদ্রাসায় ছাত্রীদের যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কওমি মাদ্রাসায় এমন ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটলেও সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসায়ও অভিযোগের মাত্রা কম নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাদ্রাসা অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই আসে অভিযোগ। তবে এবার ফেনীর মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার নেতৃত্বে ছাত্রী নুসরাতকে যৌন হয়রানি ও নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কিছু একটা করা প্রয়োজন। এমন প্রয়োজন থেকেই মাদ্রাসা বিষয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে বলে বলছেন মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা।
গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহানকে পরীক্ষা কেন্দ্রের ছাদে ডেকে নিয়ে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতহানির মামলা তুলে না নেয়ায় তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় বলে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বলে গেছেন নুসরাত। এই মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাহসহ অভিযুক্ত ১৬ জন এখন কারাগারে আছেন। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা নাড়া দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেও। এখনও অপরাধীদের বিচারে সোচ্চার সর্বস্তরের মানুষ।
জানা গেছে, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাসহ মাদ্রাসায় একের পর এক ছাত্রীর যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) বাস্তবায়নে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ সর্বোচ্চ কঠোর হওয়ার পক্ষে।
মাদ্রাসায় ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নেয়া এ বিশেষ এ উদ্যোগের পেছনে আছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা।
মাদ্রাসা বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সুপারিশের আলোকে আমরা কাজ করেছি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা ছাড়াও প্রতিটি সভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূূমিকার পালন করেছেন।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার জনকণ্ঠকে বলছিলেন, আসলে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন। তাই আমরা বিষয়টিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। সচিব এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত প্রশিক্ষণ কারিকুলামে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা আমরা বলেছি। আর সমাজে আলেম ওলামাদের কথা মানুষ বিশ^াস করে। তাদের কথার গুরুত্ব দেয়। বিষয়টিকে মাথায় রেখেই আমরা বলেছি, আলেম ওলামাদের মাধ্যমে, জু’মার খুতবায় এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে।
অভিযোগ আছে, দেশের ১৬ হাজারের বেশি মাদ্রাসার পৌনে দুই লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর শতভাগ বেতনভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সরকার নিশ্চিত করলেও এগুলো পরিচালনায় তেমন কোন নিয়ন্ত্রণই নেই সরকারের। সুপার, অধ্যক্ষ কিংবা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের স্বেচ্ছাচারিতায় পরিচালিত হচ্ছে বেশিরভাগ মাদ্রাসা। নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ লুটপাটসহ অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।