ভারতীয় সংগীত জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বশিল্পী কিংবদন্তিতুল্য গায়ক ও সংগীত নির্মাতা ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুবার্ষিকী আজ। অত্যন্ত দরাজ গলার অধিকারী এই কণ্ঠশিল্পীর জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। শিশু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অসমিয়া চলচ্চিত্রে সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই মূর্ত হয়ে ওঠে তার সংগীতপ্রতিভা।
খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর আসামের সদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নীলকান্ত হাজারিকা এবং মা শান্তিপ্রিয়া হাজারিকার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে তেজপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে গুয়াহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বিএ এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন।
‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে অল্প কিছুদিন কর্মরত থাকার পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি বৃত্তি পান এবং ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিলো ‘প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষায় শ্রবণ-দর্শন পদ্ধতি ব্যবহার করে ভারতের মৌলিক শিক্ষাপদ্ধতি প্রস্তুতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব’।
ড. ভূপেন হাজারিকা তার ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর ও কোমল ভঙ্গির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার রচিত গানগুলো ছিল কাব্যময়। গানের উপমাগুলো তিনি প্রণয়-সংক্রান্ত, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় থেকে তুলে আনতেন। তিনি আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে লোকসংগীত গাইতেন। অন্যান্য পরিচয়কে অতিক্রম করে একজন সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে তিনি নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন মানুষের মনে। বাংলাদেশ, আসাম ও তার প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে তার জনপ্রিয়তা ছিলো ব্যাপক ও বিশাল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গান গেয়ে আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ড. ভূপেন হাজারিকা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি মুক্তিবাহিনীর মনে সাহস ও শক্তি এনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। একথা অনস্বীকার্য যে ভূপেন হাজারিকার ‘হে দোলা হে দোলা’ ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘বিস্তীর্ণ দু’পারে’– এই তিনটি গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছিলো এবং হৃদয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের মতো উন্মাদনা এনে দিয়েছিলো।
এছাড়াও তাঁর গাওয়া ‘আমি এক যাযাবর’ ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনায় নজরুল’, ‘সহস্র জনে মোরে প্রশ্ন করে মোর প্রেয়সীর নাম’, ‘মাইয়া ভুল বুঝিস নাই’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’–গানগুলো অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
বহু পুরস্কার ও সম্মাননাপ্রাপ্ত এই মহান শিল্পী রেখে গিয়েছেন মানুষকে উজ্জীবিত করার মতো অজস্র সৃষ্টিকর্ম। ভূপেন হাজারিকা ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ২৩তম ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক চলচ্চিত্র ‘চামেলী মেমসাহেব’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মশ্ৰী পুরস্কারে ভূষিত হন।
৪ মাস রোগে (কিডনী বৈকল্য ও বার্ধক্যজনিত সমস্যা) ভোগার পর ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মুম্বাই কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে পরলোকগমন করেন অসমিয়া, হিন্দি ও বাংলা ভাষার গানের পাখি ড. ভূপেন হাজারিকা।