দশ বছরে স্কুলে পড়া যে কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে কলেজে পড়া। স্কুলে থাকা অবস্থায় কলেজ তাদের কাছে অনেক বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর অনেক বড় বড় নামি-দামি শিক্ষকের ক্লাসে বসার সুযোগ হয়, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেধাবী অনেকেই আসে, তাদের সঙ্গেও পড়তে পারা যায়। এছাড়া কলেজে এক ধরনের স্বাধীনতা পাওয়া যায়, যা স্কুলে থাকে না। তাছাড়া বয়স, চিন্তা-ভাবনাও এই সময়ে একটু বাড়তে থাকে। ফলে কলেজে গেলে উচ্চশিক্ষার খুব কাছাকাছি যাওয়া যায় এমন একটি ভাবনা স্কুলপড়–য়া যে কোনো শিক্ষার্থীর মনে ঘুরপাক খায়ই। এইচএসসিকে বাংলায় উচ্চ মাধ্যমিক বলি। এই উচ্চ মাধ্যমিক পার হতে পারলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেয়া যায় এমন ভাবনাও মেধাবী শিক্ষার্থীদের তো থাকেই, অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে। আসলে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই শিশু-কিশোর তরুণদের মধ্যে উচ্চতর শ্রেণিতে পড়ার স্বপ্ন এবং আনন্দ সমানভাবেই কাজ করে। হয়তো সবাই শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন পূরণ করতে পারে না। মঙ্গলবার (১৫ পেস্টেম্বর) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন প্রায় সবাই দেখে। আমরাও সেই স্বপ্ন দেখে দেখেই শিক্ষাজীবন অতিক্রম করেছি। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা পরিবেশে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নিজেদের কলেজে একাত্ম করে ফেলেছি। যে স্যারের ক্লাস শুনে মজা পাওয়া যেত সেই স্যারের ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করতে আমরা কেউই বিরক্তবোধ করতাম না। কলেজে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেয়া, অজানা বিষয়ে কারো কারো কাছ থেকে শোনা, কমনরুমে সারি সারি পত্রিকা পড়া, লাইব্রেরিতে অনেক বড় বড় বই নেড়েচেড়ে দেখা কিংবা নিজের নামে ইস্যু করে নেয়া, ইনডোর-আউটডোর খেলাধুলা, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা এসবই কলেজে পড়তে এসে আমরা ষাট-সত্তরের দশকেও দেখেছি। সে কারণেই স্বল্প সময়ের জন্য হলেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কলেজ শিক্ষাটি আমাদের সবার অন্তরে গেঁথে আছে। এখন যারা কলেজে পড়তে আসে তাদেরও একই অনুভ‚তি হওয়ার কথা।
এবার বোধহয় শিক্ষার্থীদের করোনা ভাইরাস সেই স্বপ্ন, আনন্দ ও সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। এদের ভর্তি হওয়ার কথা ছিল সেই মে-জুনে। এতদিনে তারা বেশকিছু ক্লাস শেষ করে কলেজের পাকা শিক্ষার্থী হয়ে ওঠার কথা ছিল। কোভিড-১৯ তাদের সেই সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। এখন সেপ্টেম্বরে তারা অনলাইনে ভর্তি হচ্ছে। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড অক্টোবরে তাদের অনলাইনে ক্লাস নেয়ার কথা বলছে। কলেজ দর্শন তাদের হবে কিনা কেউ বলতে পারছে না। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের তারা অনলাইন বা জুম ক্লাসে দেখতে পাবে। তবে সব কলেজের শিক্ষকরা যে তাদের অনলাইনে পাঠ দিতে পারবেন সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিছু কিছু শহরের কলেজ শিক্ষক হয়তো অনলাইন পাঠ দেবেন। কিন্তু শহুরের সব কলেজের শিক্ষকই যে তাদের অনলাইন ক্লাসে তা পারবেন এমনটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অনেক শিক্ষকই আছেন জীবনভর শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করিয়েছেন, অনেকে বেশ সুনাম অর্জনও করেছেন কিন্তু হায় করোনা! এদের অনেকেই ভালো করে ল্যাপটপ ধরতে জানেন না। কীভাবে অনলাইনে পাঠদান আকর্ষণীয় করতে হয় বা ক্লাস নিতে হয় সেটি তাদের খুব একটা জানা নেই। এখন কলেজের সেই ভালো শিক্ষক অনলাইনে ভালো পাঠদানের জন্য মোটেও প্রস্তুত নন। কী হবে এই নামি শিক্ষকের? কোভিড-১৯ জগৎটাকেই মনে হয় পাল্টিয়ে দিয়েছে।
গেল বছরও আমরা কেউ মাস্ক পরার কথা শুনেনি। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কথাও জানিনি। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার উপদেশ বেশ অপমানজনকই মনে হতো যদি কেউ এমনটি দাবি করত। কিন্তু মার্চ মাস থেকে আমরা এখন করোনার ভয়ে ঘরবন্দি জীবনযাপন করছি। জীবন-জীবিকার জন্য অনেকে বের হয়ে এলে জীবন তাদের কতটা শঙ্কামুক্ত সেটি কেউ বলতে পারছে না। প্রতিদিনই করোনা সংক্রমণের কথা শুনতে হয়। অনেক পরিচিতজনের মৃত্যুর খবরও শুনতে হয়েছে, সেই আতঙ্ক নিয়েই জীবন ও জীবিকার জন্য মানুষ বাইরে আসছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশেই এখন শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসতে পারছে না। আমাদের দেশেও অবস্থা একই রূপ। কোটি কোটি শিক্ষার্থী এখন ঘরেই আছে। কেউ কেউ অভিভাবকদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করছে, কেউ কেউ অনলাইনে শিক্ষকদের কিছু পাঠ শুনছে, কেউ কেউ সংসদ টিভি কিংবা অন্য কোনো টিভি চ্যানেলে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান অনুসরণ করছে। এখন যারা একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে তাদের কলেজ শিক্ষাজীবন শুরুই হবে কলেজ না দেখে, শিক্ষকদেরও না দেখে, এমনকি সহপাঠীদেরও না দেখে। অর্থাৎ যদি সেই কলেজের শিক্ষকরা এরই মধ্যে অনলাইন ক্লাস নিয়ে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেন, তাহলে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ভাগ্যবান বলে পরিগণিত হবে। তবে আমার ধারণা বেশিরভাগ কলেজেই অনলাইন ব্যবস্থাপনায় পাঠদান করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে অপেক্ষা করতে হবে আরো অনেকদিন। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে যদি অনলাইন পাঠদানে প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারে তাহলে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজেদের কিছুটা ধন্য মনে করতে পারেন। অবশ্য যদি শিক্ষার্থীদের অনলাইন পদ্ধতিতে শ্রেণিপাঠ শোনার আগ্রহ থাকে।
অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠে আকৃষ্ট করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীও এই পদ্ধতির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয়। যদিও আজকাল তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ দাপিয়ে বেড়ায় বলে শুনি। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য ভ‚গোল থেকে নাড়াচাড়া করার অভ্যাস অনেকেরই আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া উন্নত দুনিয়ায় অনলাইনে পঠন-পাঠনের অনেক মেটেরিয়ালই গুগলে পাওয়া যায়। সেসব দেশের শিক্ষার্থীরা এসব ব্যবহারে অনেক আগেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমাদের এখানেও কিছু কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা এসবে পারদর্শী। তবে সেই সংখ্যাটি খুবই কম। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী শ্রেণিপাঠে অভ্যস্ত। বইপুস্তক পঠন-পাঠনেও আমাদের শিক্ষার্থীদের বড় অংশই সীমিত বইয়ের ওপর নির্ভর করে থাকে। কলেজ পর্যায়ে অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। অনেক কলেজে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিপাঠেও খুব একটা উপস্থিত থাকে না। বই পুস্তকের সঙ্গেও খুব একটা যুক্ত থাকে না।
বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীই বাজারের নোটবই-গাইডবই সংগ্রহ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানের কথা বিবেচনা করলেও গড়পড়তা মান আছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমে এসেছে। গত কয়েক মাসে কোনো কোনো কলেজ অনলাইন পদ্ধতির পাঠদানের কথা শুনালেও ভেতরের গল্পটি অনেকেরই পিলে চমকিয়ে দেবে বলে আমার বিশ্বাস। কোনো এক কলেজের একজন শিক্ষক কথা প্রসঙ্গে আমায় জানালেন তার অনলাইন ক্লাসে ১/২ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে না। এর কারণ জানতে চাইলে ২/১ শিক্ষার্থী তাকে যেটি উত্তর দিল তাতে সেই শিক্ষক মহাশয়ের কয়েকদিন ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন শিক্ষার্থী বলতে চাইল লেখাপড়ার কথা এত বলেন কেন স্যার। লেখাপড়া করতে হলে তো অমুক নামি-দামি কলেজেই ভর্তি হতাম। ভাবখানা এমন যেন ওই শিক্ষার্থীরা ওইসব নামি-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাইলেই ভর্তি হতে পারত। আসলে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় খোঁজ নিলে দেখতে পাবে এই ঢাকা শহরের বেশিরভাগ কলেজেই শিক্ষার্থীরা ক্লাসে খুব একটা আসে না। অবশ্য উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এখনো বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ক্লাসে না আসার প্রবণতা তাদের অনেকের মধ্যেই স্থান করে নেয়। স্নাতক ও মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কলেজে কমসংখ্যক উপস্থিত হয়। যারা হয় তারা কমই ক্লাসে যায়, এখানে-সেখানে আড্ডা দেয়া, দলের ব্যানারে বসে গল্প করার মধ্যেই তাদের কলেজের উপস্থিতির মাজেজা পেতে হয়।
ক্লাসে উপস্থিতির হার নগণ্য বললেও কম বলা হবে। এ হচ্ছে বাংলাদেশের উচ্চ মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার হালচাল। এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যেমন হচ্ছে তা বোধহয় পরিদর্শন করে জেনে নেয়া যেতে পারে। শিক্ষাবিমুখ এমন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে আছে কিনা জানি না। তবে আমাদের এখানে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী ছাড়া একটি বড় অংশই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে উপরের দিকে শিক্ষাবিমুখ হতে থাকে। কিন্তু তারা কোথাও না কোথাও ভর্তি হচ্ছে, পরিচয় দিচ্ছে, এমনকি স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পাওয়ারও রেকর্ড করছে। বাস্তবে এদের কর্মক্ষেত্র কোথায় হচ্ছে আমরা কেউ জানি না। এই সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা কেউ গভীরভাবে ভাবছি কিনা জানি না। তবে এখনই যদি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের মানের সংকট নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা না করা হয় তাহলে নিকট ভবিষ্যতে আমাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। ৫/১০ পার্সেন্ট মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষে বের হলেও এদের একটি বড় অংশই আবার বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বাকি যারা থাকছে তারা সংখ্যায় খুব বেশি নন। এ কারণেই আমরা বিদেশিদের দ্বারস্থ হচ্ছি দেশে প্রযুক্তি পরিচালনার জন্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমাদের গবেষণা এবং চর্চা কেবলই তলানিতে ঠেকছে।
লেখক : মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।