করোনাকালে বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা

মো. হাসান তারেক |

বিশ্বব্যাপী করোনাসংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও সেই ভ্যাকসিনের সমতার ভিত্তিতে বণ্টন সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত করোনা মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

করোনাকালে লোকমুখে একটি কথা শোনা গিয়েছিল, হয়ত এ সময় বিশ্বব্যাপী সাম্যের মূলমন্ত্র ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু, দেখা গেল এই করোনা দুর্যোগকালে বিশ্বব্যাপী কষ্ট ও ত্যাগের ক্ষেত্রে সমতার বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরও বেশি দরিদ্র ও অসহায় হয়ে পড়েছে। জীবিকার তাগিদে যারা বড় বড় শহরগুলোতে পাড়ি জমিয়েছিল এখন করোনার কারণে জীবিকা হারিয়ে তারা সে স্বপ্নের শহর ছেড়ে চিরচেনা গ্রামেই ফিরে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্যখাতের এই জরুরি মুহূর্তে বেশি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বয়স্করা। করোনা দুর্যোগের কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা। করোনার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়তে পারে অনেক শিক্ষার্থী।

বিশ্বব্যাপী চলমান লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বিধানের কারণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যখন এই পরিস্থিতিতে ধনী শিক্ষার্থীরা অনলাইন মাধ্যম ও অন্যান্য উপায়ে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে, ঠিক তখনই দরিদ্র শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে শিক্ষা গ্রহণ। কিন্তু, সেই শিক্ষা ক্ষেত্রেও তারা এখন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

করোনা দুর্যোগের পূর্ব থেকে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার কার্যকর বিস্তারে অনেক দেশেই বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষার বিস্তারে তাই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা।  এখন পর্যন্ত প্রায় ২৬০ মিলিয়ন শিশু বিশ্বব্যাপী স্কুল শিক্ষার বাইরে এবং ১১ বছর বয়সের দিকে ৪০০ মিলিয়ন শিশু নানা কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে।  সাব- সাহারা আফ্রিকান অঞ্চলে বাল্যবিবাহের কারণে অনেক মেয়ে সেকেন্ডারি পর্যায়ের লেখাপড়াই শেষ করতে পারে না। বিশ্বের ৫০টি দেশে বাল্যবিবাহ বিরোধী আইন নাই। আবার, অনেক দেশে আইন থাকলেও কার্যকর করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায়, প্রতিবছর ১২ মিলিয়ন স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে।

করোনা সংকটের শেষে যখন স্কুলগুলো খুলবে তখন দেখা যাবে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরতে পারছে না। দারিদ্র্যের কারণে, দরিদ্র শিশুরা শিক্ষা থেকে দূরে থাকে। করোনা মহামারি দারিদ্র্যের হারকে প্রকট থেকে প্রকটতর করে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, দেখা যাবে দরিদ্র শিশুরা স্কুলের পরিবর্তে কর্মের সন্ধানে ছুটবে করোনা পরবর্তী সময়ে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৪টি দেশ আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার আইনের বাইরে। ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়বে এই ১৪টি দেশের শিশুরা। অনেক মেয়েই বাল্যবিবাহের মতো সমস্যার সম্মুখীন হবে। 
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে যখন পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা মহামারি আঘাত হেনেছিল তখন সিয়েরালিওনে স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে  ১৫ থেকে ১৯ বছরের ৩০ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ হারে মেয়ে সন্তান সম্ভবা হয়েছিল। এই মেয়েরা আর স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে আসেনি। করোনার পরে হয়ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, চাকরির সুযোগ সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে, কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে কি উদ্যোগ নেয়া হবে?

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে কাশ্মীরে ১৪ সপ্তাহের জন্য স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে ১ দশমিক ৫ বছরের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। করোনার কারণে, একইভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, কোভিড-১৯ এর পূর্ববর্তী সময়ে বিশ্বের ৫০টির মতো দেশ তাদের জাতীয় আয়ের ৪ শতাংশ এবং দেশীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে এই চিত্রটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে বলছে, পরের বছর নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে শিক্ষা ব্যয় আরও কমে আসবে। দাতব্য সংস্থাগুলো থেকে
সহায়তাও কমে আসতে পারে। শুধু শিক্ষার্থীরা নয় করোনার কারণে, মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে শিক্ষকরাও কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, করোনার কারণে, সৃষ্ট অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কি উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে? প্রথমত, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি সকল রাষ্ট্রের প্রধানদের সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনা যথাযোগ্য তদারকির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে। চতুর্থত, সামনের দিনগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের মনে রাখতে হবে শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে সর্বোত্তম বিনিয়োগ। অতএব, এই শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না।

লেখক : মো. হাসান তারেক, প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024490356445312