করোনার নতুন রোগী কেন বাড়ছে?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সরকার এবং গণমাধ্যম কি করোনাভাইরাস নিয়ে অতিরিক্ত করছে? এখন কি স্বাভাবিক জীবনে পুরোপুরি ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে? এগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিলে এ বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার।

শুরু করা যাক ইতিবাচক কয়েকটি বিষয় দিয়ে।

সারা বিশ্বেই করোনাভাইরাসে গুরুতর আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসছে। গত কয়েকমাস ধরেই হাসপাতালগুলোয় কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ভর্তির সংখ্যা কমছে। যুক্তরাজ্যে একসময় যখন প্রায় ২০ হাজার রোগী ভর্তি ছিলেন, এখন সেই সংখ্যা কমে এসেছে আটশোর নীচে। শনিবার (২৯ আগস্ট) বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।  প্রতিবেদনটি লিখেছেন ফার্গাস ওয়ালশ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায, একপর্যায়ে পুরো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র কোভিড-১৯ রোগীতে ভর্তি ছিল, যাদের অনেককে কয়েক সপ্তাহ ধরে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল।

ভেন্টিলেশনে রাখা রোগীর সংখ্যা তিন হাজার তিনশো হতে কমে এখন নেমে এসেছে মাত্র ৬৪ জনে।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল এপ্রিল মাসে, এরপর থেকেই তা কমতে শুরু করেছে।

করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরবর্তী ২৮ দিনের মধ্যে যাদের মৃত্যু হয়েছে, সেই হার এখন প্রায় ৯৯ শতাংশ কমে এসেছে। একসময় যুক্তরাজ্যে প্রতিদিন এরকম মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার হলেও এখন তা প্রতিদিন ১০ জনে নেমে এসেছে।

অন্যান্য রোগের সঙ্গে তুলনা করলে প্রোস্টেট ক্যান্সারে প্রতিদিন যুক্তরাজ্যে গড়ে ৩০ জনের মৃত্যু হচ্ছে আর স্তন ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন ৩০জন নারী।

তবে করোনাভাইরাসের মৃত্যুর পরিসংখ্যানের মতো সেসব মৃত্যুর খবর টেলিভিশনের খবরে ফলাও করে প্রচার করা হয় না।

তবে গত কয়েকমাস ধরেই করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেটার কারণ হয়তো হতে পারে পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক কার্ল হেনেগান বলছেন, ''মার্চ এবং এপ্রিলের দিকে যদি তাকান, তখন নাজুক ব্যক্তিদের অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা বেশি ছিল। যেমন কেয়ার হোমগুলোয় এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এখন তরুণদের মধ্যে বেশি সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে।''

''দ্বিতীয়ত, ভাইরাসটির সংক্রমণের মাত্রাও কমে গেছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলায় মানুষজন কম মাত্রায় ভাইরাসের সংস্পর্শে আসছে, কারণে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার প্রবণতাও কমে গেছে।''

সুতরাং এখন কাউকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলেও তার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি। চিকিৎসকরা এখন আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছেন যে, কোভিড-১৯ এর সঙ্গে কীভাবে আরও দক্ষতার সঙ্গে লড়াই করা যাবে।

সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ২ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি চারদিনে প্রায় ১০ লাখ নতুন রোগী যোগ হচ্ছে।

মহামারি শুরু হওয়ার পর বিশ্বে আট লাখের বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

তবে সেটা ফুসফুসের আরেকটা সংক্রামক ব্যাধি, যক্ষ্মায় মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়াতে পারেনি।

বাতাস বাহিত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, টিউবারকুলোসিস বা টিবি রোগে প্রতি বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রায় ১৫ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। দারিদ্র, অপুষ্টি, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কখনো কখনো এইচআইভির কারণেও মানুষজন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

তবে কোভিডের সঙ্গে পার্থক্য হলো, অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এটা অনেক সময় চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। যদিও ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার ঊর্ধ্বগতিও লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা।

কিন্তু এখন কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে?

এর মানে যদি হয় যে, শিশুদের স্কুল খুলে দেয়া, তাহলে উত্তর হতে পারে হ্যাঁ। কারণ তথ্যপ্রমাণ বলছে যে, শিশুদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। যদিও তাদের পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

তবে বয়স যত বেশি হবে, তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ততো বেশি হবে।

অধ্যাপক ডেভিড স্পিগেলহালটারের মতে, বিশ বছরের একজনের তুলনায় আশি বছরের একজন পুরুষের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৫০০ গুণ বেশি।

তবে এই ভয়াবহ রোগটির বিরুদ্ধে বিজয়ে আমাদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে।

এখনো আসলে গ্রীষ্মকাল চলছে। ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়, এমন ভাইরাস গ্রীষ্মের মাসগুলোয় ততটা শক্তিশালী হয় না। মানুষ এখনো বাইরে সময় কাটাচ্ছে। যদিও বেশিরভাগ মানুষ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে, কারো সঙ্গে হাত মেলায় না। সুতরাং একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এখনো করোনাভাইরাস দূর হয়নি।

মানুষজন যেহেতু অফিস-আদালত করতে শুরু করেছে, বাইরে বের হচ্ছে, অতএব সামনের কিছুদিন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বোঝার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

''আমরা জানি, শীতের সময় বিশেষ করে উত্তরের আবহাওয়ায় ফুসফুসের ভাইরাস বিশেষভাবে বেড়ে যায়। সুতরাং এটা এখনো শেষ হয়নি, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে,'' বলছেন ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ওয়েন্ডি বারক্লে।

ফ্রান্সে দেখা গেছে, সেখানে শুধু নতুন রোগী শনাক্ত নয়, বরং কোভিড-১৯ জনিত অসুস্থতার হার অনেক বেড়ে গেছে।

''মানুষজন যদি মনে করে যে, ভাইরাসের সংক্রমণ শেষ হয়ে গেছে, সেটা ভুল হবে। ভাইরাসটি এখনো ছড়াচ্ছে এবং আমরা যদি সতর্ক না থাকি, অসুস্থতার হার আরও বাড়বে। আমার মতে, মানুষকে এই পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে যেন তারা হাত ধোয়া আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে।'' বলছেন অধ্যাপক কার্ল হেনেগান।

তিনি এক্ষেত্রে সুইডেনের উদাহরণ অনুসরণ করার পরামর্শ দেন, যেখানে কখনোই লকডাউন দেয়া হয়নি।

''সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল আচরণ করা ছাড়া তারা বাড়তি কিছু করেনি। এর মানে হলো রেস্তোরা খোলা থেকেছে, কিন্তু মানুষজন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেছে এবং কি করছে, সে বিষয়ে সতর্ক থেকেছে।'' তিনি বলছেন।

তিনি বলছেন, কীভাবে কিছু মানুষ সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্ষমতা অর্জন করেছে, সেটাও বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ।

সম্ভবত প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু সেখানে টি-সেলের একটা প্রভাব আছে, যেটি সংক্রমিত সেল শনাক্ত এবং ধ্বংস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পাশাপাশি তিনি মনে করেন, করোনাভাইরাস আরও কিছুদিন থেকে যাবে।

''আমি মনে করি, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি সফলভাবে পশুপাখি থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছে এবং সেটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবন কম। সবচেয়ে বড় আশা হতে পারে টিকা, যা নাজুক ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক হবে।'' তিনি বলছেন।

এডিনবরা ইউনিভার্সিটির ইমুউনোলজি এন্ড ইনফেকশন ডিজিজেস বিভাগের অধ্যাপক ইলেনর রাইলি বলছেন, মহামারির শুরুতে যতটা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে, দ্বিতীয় দফার সংক্রমণের জন্য তার চেয়ে ভালো প্রস্তুতি নেয়া দরকার।

''আমরা হয়তো রোগী শনাক্তের ক্ষেত্রে সংখ্যা বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার মনে হয় না যে, সেটা এপ্রিল মাসের মতো হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়বে,'' তিনি বলছেন।

''আমরা এখন ব্যক্তি বিশেষে ঝুঁকির বিষয়টি ভালোভাবে জানি এবং সেভাবে বয়স্ক ও স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারি। পাশাপাশি অন্য সবাই তাদের নিয়মিত জীবনযাপন চালিয়ে যেতে পারেন।''

এর মানে হলো, মহামারি নিয়ন্ত্রণে এখনো আমাদের প্রত্যেকের বিশেষ ভূমিকা রাখার প্রয়োজন রয়েছে। সামাজিক দূরত্ব এবং হাত ধোয়ার অভ্যাস বজায় রাখা জরুরি। বিশেষ করে যাদের সঙ্গে বসবাস বা ঘনিষ্ঠতা নেই, তাদের থেকে দূরে থাকাই ভালো।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005763053894043