করোনার প্রভাব মোকাবেলায় আসছে বড় বাজেট

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনা নিয়ে এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যিনি বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। আগামী ১১ জুন বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণা করা হবে। করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর বিশ্বে এমন ভয়াবহ সংকট আর দেখা যায়নি। এই সংকটকে ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিনতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এত খারাপ সময় আর কখনই আসেনি। দেশের অর্থনীতির চাকা স্থবির। যেভাবেই হোক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হবে। রোববার (১০ মে) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আবু কাওসার। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, করোনার কারণে অংশীজনের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা স্থগিত করা হলেও ওয়েবসাইটে মতামত চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামতের মাধ্যমে বাজেটকে আরও অংশগ্রহণমূলক করতে চায় সরকার। সে লক্ষ্যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাকালে এবার গতানুগতিক বাজেট নয়। করতে হবে বিশেষ বাজেট। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হবে করোনার প্রভাব মোকাবেলায় মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা। এ জন্য দরকার সহায়ক নীতি সহায়তা। জনস্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষায় বেশি নজর দেওয়া।

জানা গেছে, সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকার পরও বড় বাজেট দেবে সরকার। যুক্তি হলো : করোনা-দুর্যোগে স্বাস্থ্য, খাদ্য, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ নানা খাতে সরকারি ব্যয় বেড়েছে। বিনামূল্যে চাল বিতরণ, দশ টাকা দামে গরিব মানুষকে চাল সরবরাহ করা, করোনাকালীন কর্মহীন মানুষকে নগদ টাকা দেওয়া, অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণাসহ নানা আর্থিক সুবিধা দেওয়ায় ভর্তুকির চাপ বেড়ে গেছে। এ জন্য বাড়তি অর্থ জোগান দিতে হবে। এ ছাড়া বেশি ব্যয় করলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা চাঙ্গা থাকবে। এতে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। এসব বিবেচনা করে করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় বিশাল অঙ্কের বাজেট করছে সরকার।

সম্ভাব্য আকার : সূত্র বলেছে, আসন্ন বাজেটে বিশাল ঘাটতির প্রস্তাব করা হচ্ছে। জিডিপির ৫ শতাংশ ঘাটতি প্রাক্কলন করে দেশে সাধারণত বাজেটের আকার তৈরি হয়। কিন্তু এবার সেই প্রথা ভেঙে ঘাটতি ৬ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। অর্থাৎ আয় ও ব্যয়ের মধ্যে আগের চেয়ে বেশি ব্যবধান থাকছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৫ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে ঘাটতি হতে পারে টাকার অঙ্কে এক লাখ ৭২ থেকে এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি হতে পারে ৩ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে সংগৃহীত লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাকি রাজস্ব আসবে এনবিআরের বাইরে কর বহির্ভূত রাজস্ব খাত থেকে।

সূত্র জানায়, এবার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আরও বেশি হারে অর্থের জোগান দেওয়া হবে। ফলে ঘাটতি মেটাতে নতুন বাজেটে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা অনেক বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিশাল ঘাটতি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ, জরুরি সময় অনেক দেশেই বাজেট ঘাটতি বেশি ধরা হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে জিডিপির ৬ থেকে ৭ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি ধরে বাজেট করা হয়। তাদের মতে, ঋণের টাকা নিয়ে কোথায় এবং কীভাবে ব্যয় করা হচ্ছে- সেটিই হচ্ছে আসল কথা। স্বাস্থ্য, খাদ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও উৎপাদনমুখী খাতে ব্যয় করলে আসন্ন বাজেটের সুফল মিলবে।

জানা যায়, চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) মূল বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এতে ঘাটতি ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। বর্তমানে মূল বাজেট সংশোধন করে ৫ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। রাজস্ব আয়ে ধস নামায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে চলতি বাজেটে অতি মাত্রায় ঋণ নেওয়া হয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা মূল বাজেটে ধরা হয় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণ গ্রহণ অনেক বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জিডিপি : আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হতে পারে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। যদিও আইএমএফ বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি হবে ২ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ।

সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অনেক বাড়ানো হচ্ছে। করোনা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সহায়তায় কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকিসহ এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ খাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সামগ্রিকভাবে বর্তমান ৭৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, নতুন কোনো কর বা করহার বাড়ছে না। তবে করপোরেট কর কমানো হচ্ছে না। উচ্চবিত্তদের কাছ থেকে আদায় বাড়াতে সারচার্জ বাড়ানো হতে পারে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের সুরক্ষায় শর্তসাপেক্ষে কিছুটা কর ছাড় দেওয়া হতে পারে। করোনার কারণে যারা সময়মতো প্রযোজ্য কর দিতে পারেনি, তাদের দণ্ড সুদ মওকুফ করে দেওয়া হবে। মূল্য সংযোজন করে একই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আমদানি ক্ষেত্রে বিলাস ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কিছু পণ্যে শুল্ক্ক বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে সিগারেট ও টোব্যাকোতে শুল্ক্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকছে। এনবিআরের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনতে আসন্ন বাজেটে সহায়ক নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রশাসনিক সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বক্তব্য : বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডক্টর আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনার ভয়াবহতা না কমলে নতুন বাজেট করে কোনো লাভ নেই। লক্ষ্য হওয়া উচিত আগামী ৬ মাসের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট করা। করোনার কারণে পূর্ণাঙ্গ বাজেটের কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হবে না। আগামী বাজেটে অর্থায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রয়োজনে টাকা ছাপিয়ে করতে হবে। দাতাদের কাছ থেকে বেশি টাকা আনতে হবে। জোর দিতে হবে সংস্কারে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন গবেষণা পরিচালক বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডক্টর জায়েদ বখত বলেন, আমাদের দেশে বাজেটের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তা জিডিপির তুলনায় অনেক কম। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে আরও বেশি খরচ করা হয়। কাজেই বাজেটে আরও বেশি ব্যয় করার সুযোগ আছে। রাজস্ব আয়ের অবস্থা খারাপ। বিকল্প হিসেবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। এখন সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেলেও আগামীতে বাড়বে। ফলে আমি শঙ্কিত নই। এবার রাস্তাঘাট জরুরি নয়। কভিড-১৯-এর অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন বাজেট সাজাতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বড় বাজেট এবার দরকার আছে বলে মনে করেন তিনি।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নীতি-সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর সেলিম রায়হান বলেন, এখন দরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা। ফলে বেশি ঘাটতি নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। বিশেষ বাজেট করতে হবে এবার। এতে অর্থনীতির গতি ফেরাতে দুই বছরের একটি পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025570392608643