করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ বন্ধের তালিকায় দ্বিতীয় বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে উত্তর আমেরিকার দেশ পানামায়। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। কয়েক ধাপে এই ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর পর চলতি বছরের ২৩ মে থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে বলে গত ২৫ মার্চ জানান শিক্ষামন্ত্রী।

তবে, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে সেই ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২৯ মে পর্যন্ত করা হয়। সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে না আসায় পুনরায় ছুটি ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে গত ২৯ জুলাই আবারও সেটি বাড়িয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করা হলো।  এ নিয়ে গত সাড়ে ১৬ মাসে মোট ২২ দফা বাড়ানো হলো ছুটি। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টানা বন্ধ দাঁড়াচ্ছে ৫৩৩ দিনে।

মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আশা করি  যেভাবে সংক্রমণের হার ক্রমেই নিচে নেমে আসছে। এটা আমাদের জন্য সুখবর।  এই নিম্নগতি থাকলে খুব শিগগিরই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারবো। তবে ধাপে ধাপে খুলবো। কারণ আমাদের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা পৃথিবীর যেকোনও দেশের তুলনায় বেশি। কারণ করোনা প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব গুরুত্বপূর্ণ। 

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে জানা যায়, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বের প্রায় ১৪ কোটি শিশু প্রথমবারের শিক্ষার্থী হিসেবে একদিনও স্কুলে যেতে পারেনি। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ প্রথমবারের শিক্ষার্থীও রয়েছে। এ কারণে সশরীরে শিক্ষা গ্রহণের প্রথম দিনটির জন্য তারা এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে এবং এই অপেক্ষা বেড়েই চলেছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে, যা কোভিড-১৯ এর কারণে স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম। বাংলাদেশে মহামারির পুরোটা সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইউনিসেফ বলছে, এভাবে যতো বেশি সময় ধরে শিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে, সহিংসতা, শিশুশ্রম, বাল্য বিবাহের ঝুঁকি ও তাদের স্কুলে ফিরে আসার সম্ভাবনা ততই কমে যাবে।

বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, স্কুলে সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষাগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ থাকা শিশুদের কেবল পড়াশোনার ক্ষেত্রে নয়, একইসঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এবং মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার উপর অত্যন্ত গুরুতর প্রভাব ফেলছে। প্রান্তিক শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, যা তাদেরকে অধিকতর দারিদ্র্য ও অসমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। নিরাপদে স্কুল পুনরায় খুলে দেওয়া এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনিয়োগ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আজকের একটি সিদ্ধান্ত এই শিশুদের পুরো জীবনকে প্রভাবিত করবে।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, স্কুলের প্রথম দিন একটি শিশুর জীবনে উল্লেখযোগ্য এক মুহূর্ত, যা তাদেরকে ব্যক্তিগত শিক্ষা অর্জন এবং বিকাশের ক্ষেত্রে একটি জীবন পরিবর্তনকারী পথে পরিচালিত করে। আমরা বেশিরভাগই স্কুলের প্রথম দিনের অসংখ্য ছোটখাটো বিবরণ মনে রাখি। যেমন; কী পোশাক পরেছিলাম, শিক্ষকের নাম, কার পাশে বসেছিলাম। তবে লাখ লাখ শিশুর জন্য সেই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যখন বিশ্বের অনেক জায়গায় ক্লাস পুনরায় শুরু হয়েছে, তখন প্রথম শ্রেণির লাখ লাখ শিক্ষার্থী এক বছরেরও বেশি সময় পর সশরীরে ক্লাসরুমে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। আরও লাখ লাখ শিশুর হয়তো এই মেয়াদেও স্কুলে একেবারেই যাওয়া হবে না। যারা সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে তাদের জীবনে আর কখনোই স্কুলে ফিরতে না পারার ঝুঁকি প্রবল বেগে বাড়ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী স্কুলগুলো গড়ে ৭৯ শিক্ষা-দিবস পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তবে মহামারি শুরুর পর ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য স্কুলগুলো প্রায় পুরো বছর বন্ধ ছিল। এমনকি এখনও অনেক শিশুর দ্বিতীয় বছরের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিশুর, বিশেষ করে বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে থাকা ছোট শিক্ষার্থীদের, শেখার ক্ষতি, মানসিক চাপ, টিকা না পাওয়া এবং ঝরে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি, শিশুশ্রম ও শিশুবিয়ের মতো পরিণাম ভোগ করতে হবে।

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে যত দ্রুত সম্ভব সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুলগুলো পুনরায় খুলে দিতে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিস্তৃত পরিসরে সহায়তা প্রদান করতে সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সমাধানমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা না হলে এই পুরো প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আয়ের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তা প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।’

এদিকে করোনা মহামারির কারেণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পুষিয়ে আনতে বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর সঙ্গে মিলে ইউনিসেফ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে :

১. সব শিশু এবং তরুণদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মনোসামাজিক সুস্থতা এবং অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্য তারা তাদের প্রত্যেকের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবে।

২. শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহায়তা করবে এমন কার্যকর প্রতিকারমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

৩. শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শিক্ষকদের সহায়তা দেওয়া।

এর আগে গত মার্চে ইউনিসেফ স্কুল বন্ধ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী ১৪টি দেশের বেশিরভাগ স্কুল ২০২০ সালের মার্চ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ সাল পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। এই দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের, যেসব দেশে প্রায় ৯ কোটি ৮০ লাখ স্কুলগামী শিশুর ওপর এর প্রভাব পড়েছে। এই ১৪ দেশের মধ্যে পানামাই সবচেয়ে বেশি দিন স্কুল বন্ধ রেখেছে এবং এর পরে এল সালভাদোর, বাংলাদেশ ও বলিভিয়া রয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006101131439209