করোনা পরিস্থিতিতে পারিবারিক সহিংসতা যেভাবে বাড়ছে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউনে রয়েছে বিশ্বের বহু দেশ। এসময় ঘরের ভেতর যারা পারিবারিক ও যৌন নির্যাতনের মুখে পড়ছেন তারা এই মহামারির নীরব শিকার বলে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে।

বিভিন্ন সংগঠন বলছে সাধারণ সময়ে এসব নির্যাতন থেকে বাঁচতে যারা বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা পেতেন বা সাহায্য নিতেন সেরকম নারীদের জন্য এখন একটা কঠিন সময়। কারণ লকডাউনের কারণে তারা না যেতে পারছেন বাইরে বা বাইরে থেকে তাদের সাহায্য করতেও এসব সংস্থাগুলো পারছে না, কারণ সব জায়গায় সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ব্রিটেনে নির্যাতনের ঘটনা রিপোর্ট করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে যে হটলাইনের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে গত সপ্তাহান্তে ৬৫ শতাংশ বেশি টেলিফোন কল এসেছে বলে সরকার জানিয়েছে।

এদিকে জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে ছোট ঘরের মধ্যে যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাদের পক্ষে এসব অত্যাচার নির্যাতনের কথা বাইরে জানানোর সুযোগ এখন খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে।


এরকম দুজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছে যারা এই লকডাউনে এমন পুরুষের সঙ্গে রয়েছেন যারা তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।

ভারতের বাসিন্দা গীতা
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ভারত ২১ দিনের জন্য সারা দেশে পুরোপুরি লকডাউন ঘোষণা করার আগের দিন এই সাক্ষাৎকারটি নেয়।

গীতা ঘুম থেকে ওঠে ভোর পাঁচটায়। তার স্বামী শুয়েছিল মেঝেতে তার পাশে। খুব জোরে তার নাক ডাকছিল।

আগের রাতে সে ঘরে ফিরেছে মাতাল অবস্থায়। সে খুব মনমরা ছিল। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষজন গণপরিবহন ব্যবহার করছে খুবই কম। কাজেই গীতার স্বামী অটো রিক্সাচালক ভিজয়ের আয় রোজগার কমে গেছে অনেক। আগে সে দিনে কামাতো ১,৫০০ রুপি, এখন তা নেমে এসেছে দিন ৭০০ রুপিতে।

“আর ক’দিন এভাবে চলবে?” ভিজয় চিৎকার করতে করতে তার হাতের মদের বোতলটা ছুঁড়ে মারল দেয়ালে। গীতার বাচ্চাগুলো ভয়ে মায়ের পেছনে গিয়ে লুকালো।

ভাগ্য ভাল, চিৎকার চেঁচামেচি ও বোতলটা ছুঁড়ে মারার পর ভিজয় মাটিতে বিছানো তোষকটার ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ওই ছোট তোষকটাই গোটা পরিবারের বিছানা।

“বাচ্চাগুলোকে শান্ত করতে বেশ কিছুক্ষণ লাগল,” বলছিলেন গীতা। “তারা জীবনে বহুবার বাপকে রাগতে দেখেছে, চেঁচাতে শুনেছে, কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছে। তারা দেখছে বাবা দেয়ালে জিনিসপত্র ছুঁড়ছে আর আমাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।”


গীতার স্বামী তাকে যে কতবার মেরেছে তা তিনি গুনে বলতে পারবেন না। প্রথমবার মেরেছিল বিয়ের রাতে। গীতা একবার তাকে ছেড়ে চলে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ভিজয় তাকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে দেবে না।

তারা গ্রামের দরিদ্র এক মহল্লায় থাকেন।

রোজ গীতাকে এক কিলোমিটার হেঁটে কাছের কুয়া থেকে পানি আনতে হয়। বাসায় ফিরে প্রতিবেশিদের সঙ্গে দুচার কথা বলার একটু সুযোগ হয়, যতক্ষণ তারা সব্জিওয়ালার ঠেলাগাড়ি আসার জন্য অপেক্ষা করেন।

বাজার শেষ করে গীতা নাস্তা বানাতে যান। তার স্বামী বেরিয়ে যায় সকাল প্রায় সাতটা নাগাদ। দুপুরে সে ঘরে ফেরে খেতে, তারপর একটু বিশ্রাম করে আবার বেরিয়ে যায় বড় দুটো ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ফেরার পরপরই।

“কিন্তু ১৪ তারিখে স্কুল বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে সব কিছু বদলে গেছে,” বলছেন গীতা। “বাচ্চারা এখন সবসময় বাসায় থাকছে এবং আমার স্বামী তাতে বিরক্ত।”

“সাধারণত সব রাগ সে ঝাড়ে আমার ওপর দিয়ে, কিন্তু এখন সে বাচ্চাদের ওপর ছোটখাট বিষয় নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করেছে। যেমন মাটির ওপর কেন তারা কাপ রাখল- এরকম তুচ্ছ ব্যাপার। আমি তখন কিছু একটা বলে তার মনোযোগ ঘোরানোর চেষ্টা করি, যাতে তার রাগটা আমার ওপর এসে পড়ে। কিন্তু ঘরে তার সঙ্গে সবসময় থাকতে হলে কী বলে যে আমি তার মনোযোগ ঘোরাবো বুঝতে পারছি না।”

গীতার একটা পরিকল্পনা ছিল। তার স্বামী যখন কাজে বেরতো, ঘরদোরের কাজ সেরে তিনি মহল্লার বাইরে একটা অফিস ভবনে যেতেন। সেখানে একজন বেসরকারি উদ্যোক্তা গোপনে একটা ঘরে মহিলাদের সেলাই ও লেখাপড়া শেখাতেন। কোথাও কোন সাইনবোর্ড বা কিছু থাকতো না।

গীতা ভাবছিলেন কিছু লেখাপড়া ও হাতের কাজ শিখতে পারলে আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে পারবেন আর তখন বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে যাবেন। ওই ক্লাসে একজন কাউন্সেলরও আসতেন যিনি ঘরে যারা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার তাদের সাহায্য ও পরামর্শ দিতেন।

কিন্তু ২৪শে মার্চ থেকে ভারতে ২১দিনের লকডাউন শুরু হবার পর থেকে এসব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। পাড়ায় মহল্লায় যারা নির্যাতিত নারীদের সাহায্য করতেন তারাও এখন ঘরের ভেতর।

রাজস্থানের যোধপুরে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সামভালি ট্রাস্ট ইতোমধ্যেই বলেছে করোনাভাইরাসের কারণে এধরনের মহিলারা বড়ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

“পুরো লকডাউন মানে ঠেলাগাড়িতে করে বাজারের পণ্যসামগ্রী আর গ্রামে পৌঁছচ্ছে না। ঘরের মেয়েদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পায়ে হেঁটে অনেক দূর যেতে হচ্ছে,” বলছেন সংস্থার ভিমলেশ সোলাঙ্কি।

“যেসব বাসায় স্বামীরা যে কোন ছুতোয় বৌকে মারধোর করেন, সেসব বাসায় নির্যাতনকারী স্বামীরা এখন নির্যাতনের আরও নতুন নতুন ছুতো খুঁজে পাচ্ছেন।”

বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে এধরনের পুরুষদের কাছে স্ত্রীরা এখন হয়ে উঠেছে তাদের রাগ দেখানোর সহজ জায়গা।

নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা কাই
কাই তার ফোনে একটা মেসেজ টাইপ করেছিল, “মা চান আমি তোমার সঙ্গে থাকি” ‘সেন্ড’ বোতামে চাপ দিয়েছিল সে। উত্তরও এসে গিয়েছিল সাথে সাথে: “ঠিক আছে।”

গত সপ্তাহে তরুণী কাই ফিরে গেছে যে বাসায় সে আর জীবনে পা রাখবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল সেখানে। “যে মুহূর্তে ওই বাসায় ঢুকলাম, মনে হল আমার মাথার ভেতর সব অনুভূতিগুলোর দরোজা বন্ধ হয়ে গেল,” বলছিল কাই।

কাই ফিরে গেছে তার বাবার কাছে, যে বাবা তাকে বছরের পর বছর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করেছে।

মাত্র দু সপ্তাহ আগেও কাই ভেবেছিল করোনাভাইরাস নিয়ে মিডিয়ায় এসব হৈচৈ একটা সাময়িক ব্যাপার। অল্পদিনে মিটে যাবে।

কিন্তু এখন যেভাবে এই ভাইরাস পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, ১৭০টি দেশে এর সংক্রমণ ঘটেছে, এমনকী নিউ ইয়র্কেও এই ভাইরাস থাবা বসিয়েছে, কাই বলছিলেন তাতে মানুষ রীতিমত নার্ভাস হয়ে পড়েছে।

“আমার মা যে দোকানে কাজ করতেন সেখানে তাকে প্রতিদিন খদ্দেরদের সামনে আসতে হতো। সে নিয়ে একটা উদ্বেগ তো ছিলই। কিন্তু সে উদ্বেগ কেটে গেছে। এখন দোকান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। কর্মচারীদের ছাঁটাই করা হয়েছে।”

কাই-এর মা ঘন্টা প্রতি ১৫ ডলার পেতেন। সে চাকরি তিনি হারিয়েছেন। তাকে বলা হয়েছে তার স্বাস্থ্য বীমা পাঁচ দিন পর্যন্ত বহাল রাখা হবে। তার মা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

কাই ছোটবেলা থেকেই দেখেছে মায়ের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থা।

“সেদিন মা হঠাৎ করেই চিৎকার শুরু করলেন। এখানে পাগল হবার মত অবস্থা- তুমি বাবার কাছে গিয়ে থাকো,” বলছিল কাই।

শুনে কাইয়ের শরীরের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল সময়ে মায়ের মাথা ঠাণ্ডা হলে মা তার কথা ফিরিয়ে নেবেন। কিন্তু কাই বেশ অনেকক্ষণ পরে যখন মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মা শুধু বললেন, “তুমি এখনও এখানে কী করছো?”

বাবা কাই-য়ের ওপর বছরের পর বছর যে যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল তার জন্য মাত্র কয়েক মাস আগে কাই-য়ের মানসিক চিকিৎসা শুরু হয়েছে।

কাই বলছে সে যখন শিশু তখন থেকেই বাবা তার ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। সে মা বা বোনকে এখনও নির্যাতনের বিস্তারিত খুলে বলতে পারেনি।

কাই বলছে চিকিৎসায় কিছু ফল পেতে সে সবে শুরু করেছিল। কিন্তু যেখানে সে যাচ্ছিল সাহায্যের জন্য, সেই থেরাপি কেন্দ্র করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

গত সপ্তাহে বাবার বাসায় ফিরে গেছে কাই। ফিসফিস করে সাংবাদিককে কাই বলছিল, “সারাদিন বাবা বাসায় থাকে। দিনের বেলা কমপিউটারে টিভি দেখে আর রাতে পর্ন ছবি দেখে।”

সে বলছিল সকালে উঠে বাবা জোরে জোরে শব্দ করে প্রাত:রাশ বানায়। “ওই আওয়াজ আমার জন্য একটা বিভীষিকা। আমি বুঝি বাবা জেগে আছে। আমাকে সজাগ থাকতে হবে।”

বাবার বাসায় ফেরার পর কাই ভাল করে ঘুমায়নি। তার ঘরের দরোজা ভেতর থেকে লক করার ব্যবস্থা নেই।

অতীতে কাই দেখেছে সে যখন বাবার বিরক্তি উদ্রেক করে এমন কিছু করেছে তখন বাবা তার ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে। তাই সে বাবার ধারে কাছে ঘেঁষছে না। নিজের ঘরেই থাকছে, শুধু বাথরুমে যাবার বা খাবার জন্য ছাড়া ঘরের বাইরে বেরচ্ছে না।

ভয়ার্ত কাই-এর একটাই আশা- মা তাকে শিগগিরি ফেরত নেবেন। অথবা করোনাভাইরাসের উদ্বেগ কেটে গেলে সে অন্তত সাহায্য সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়ে আর কোথাও থাকার জায়গা খোঁজার চেষ্টা করবে।

ব্রিটেনের পারিবারিক সহিংসতা বিষয়ক কমিশনার নিকোল জেকবস বলেছেন পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা খুবই বাড়ছে এবং তারা এসব মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।

জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের নির্বাহী পরিচালক বলেছেন আমেরিকা ও ব্রিটেনের মত পৃথিবীর উন্নয়নশীল বেশির ভাগ দেশে হটলাইনে সাহায্য চাইবার মত ব্যবস্থা নেই।

তিনি বলছেন এসব দেশে যেখানে নিম্ন আয়ের পরিবারে এক বা দু কামরার মধ্যে মানুষকে দিন কাটাতে হয় সেখানে নির্যাতনকারীর অত্যাচারের প্রতিকার চাওয়া এই কঠিন সময়ে নির্যাতিতদের জন্য একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।

এখানে দুজন নারীর নাম বদলে দেয়া হয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024609565734863