করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। খোলার কথা ঈদের পর জুন মাসের শুরুতে। এটা অবশ্য নিশ্চিত নয়, ছুটি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়াতে পারে—এমন আভাসও আছে। দেশে কভিড আক্রান্তের সংখ্যা এখনো বাড়ছে প্রতিদিন, কমে আসা শুরু করবে কবে তা কেউ জানে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ আছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সম্প্রতি অনুমতি দেওয়া হয়েছে অনলাইন কার্যক্রম চালানোর। তাদের পক্ষে এটা হয়তো সম্ভব। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সে রকম অবকাঠামো নেই, তাদের অপেক্ষা করতে হবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। শুক্রবার (২২ মে) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, শহুরে মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানদের বাচ্চারা অনেকেই প্রাইভেট স্কুলে পড়ে, যাদের বেশির ভাগ ও লেভেল, এ লেভেল বা আইবি (ইন্টারন্যাশনাল ব্যাকালরিয়া) সিলেবাস অনুসরণ করে। স্কুলগুলোতে লেখাপড়ার মান সাধারণত ভালো, দু-তিন মাসের এই ঘাটতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে। আইবি তো স্কুলের ফলাফলের ভিত্তিতেই সার্টিফিকেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্কুলের মানের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে এটা করাই যায়। ভারতের কোদাইকানাল স্কুল বাইরের কোনো সিলেবাস অনুসরণ করে না, তাদের স্কুলের দেওয়া সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে ভারতের এবং বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায়। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীন স্কুলগুলো, যারা দেশীয় সিলেবাস অনুসরণ করে পরীক্ষা দেয়, তারা লেখাপড়ার এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠবে কী করে? বিশেষত গ্রামের স্কুলগুলোর ছাত্রদের কী হবে? এক মাসে তো আদৌ লেখাপড়ার ধারেকাছে যায়নি তাদের বেশির ভাগ।

সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় এ রকম একটা প্রতিবেদন দেখলাম যে সিলেবাস কমিয়ে সহজ একটা পরীক্ষা নিয়ে ছেলে-মেয়েদের পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার সিদ্ধান্ত হতে পারে। আমার এ লেখার উদ্দেশ্য এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে সম্ভাব্য এ রকম সিদ্ধান্তের ফলাফল সম্পর্কে খানিক আলোকপাত করা।

আমাদের এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে, সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধ এবং পূর্বাপর মিলিয়ে এক বছর লেখাপড়া হয়নি। বোর্ডের পরীক্ষা অবশ্য নিয়েছিল তদানীন্তন সরকার, যে পরীক্ষায় বেশ কিছু ছাত্র অংশ নিয়েছিল। এ পরীক্ষার ফলাফল স্বাধীনতার পর বাতিল করা হয়। যথারীতি এক বছর দেরিতে ১৯৭২-এর এপ্রিলে আমরা এসএসসি পরীক্ষা দিই। এ সময় আরো কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফল ছিল। প্রথমত, এক বছরের অটো প্রমোশন, যার ফলে আমাদের এক বছরের কনিষ্ঠ যারা, যাদের স্বাভাবিকভাবেই ১৯৭২-এ পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তারাও আমাদের দুই মাস পরই পরীক্ষা দেয়। এই ব্যাচটি সত্যিকার অর্থে দশম শ্রেণিতে পড়েইনি। একইভাবে এইচএসসিতেও ১৯৭২ সালে দুটি ব্যাচ পরীক্ষা দেয়। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি ছিল আরো গুরুতর। আমরা তো পুরো দুই বছর পড়ে সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষার জন্য তৈরিই ছিলাম। কিন্তু সম্পূর্ণ বিনা কারণে ৩০০ নম্বরের একটা সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নিয়ে আমাদের এসএসসি সার্টিফিকেট দেওয়া হলো। সিদ্ধান্তের বাইরে আরো একটি কাজ হলো, সেটি হচ্ছে ১৯৭২ সালের চারটি পরীক্ষায়ই অবাধ ও সীমাহীন নকলবাজি, যার কারণে মেধার স্বাভাবিক মূল্যায়নও ওলটপালট হয়ে গেল। আমার যে বন্ধু দুই বছর পরের এইচএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়, সে এসএসসিতে হয়ে গিয়েছিল মেধাতালিকায় দ্বিতীয়! পাসের হারও হঠাৎ করে ৬০-৬২ শতাংশ থেকে একলাফে ৯৫ পার হয়ে যায়।

এই তাড়াহুড়ায় শেষ পর্যন্ত লাভ হয়নি কোনো; বরং ক্ষতি হয়েছে অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই চাপ নিতে পারেনি, ফলে সেশনজট প্রকট আকার ধারণ করে (সেশনজটের জন্য অবশ্য আরো কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল)। ১৯৭৭-এর এমএ পরীক্ষা আমরা দিয়েছিলাম ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা এক বছর ব্যয় করেছি, এটা মেনে নিয়ে সবারই সেশন এক বছর পিছিয়ে দিয়ে সে অনুযায়ী পরীক্ষা নিলে এই অরাজকতা অনেকটা পরিহার করা যেত।

করোনা মহামারিতে অন্তত তিন মাস বা এর চেয়ে বেশি সময় হারাবে শিক্ষার্থীরা—এটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমার বিনীত পরামর্শ হবে এটাকে বাস্তব সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া। গুটিকয়েক ‘ভালো’ স্কুল বাদ দিলে গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষার মান এমনিতেই সুবিধার নয়। সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর প্রবল জিপিএ ৫ প্রীতির কারণে কাগজে-কলমে অনেক ‘মেধাবী’ সহজ বাংলা-ইংরেজিও ঠিকমতো পড়তে পারে না। এ অবস্থায় যেভাবেই হোক পাস করিয়ে ওপরের শ্রেণিতে তুলে দিলে এই শিশুদের দুর্বলতাই শুধু বাড়বে। অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়, তাই ১৯৭২ সালে যে কাজটা করা হয়নি, সেটা করা হোক এখন। ২০২১-এর স্কুল সেশন তিন মাস পিছিয়ে এপ্রিল থেকে শুরু করা হোক জানুয়ারির পরিবর্তে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্কুল সেশন বিভিন্ন সময়ে শুরু হয়। এমনকি আমাদের দেশেও ক্যাডেট কলেজগুলোতে কিন্তু সেশন শুরু হয় জুলাই মাস থেকে। অনেক দেশেই জুলাই বা সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল শুরু। পার্শ্ববর্তী ভারতের কেন্দ্রীয় বোর্ডের সেশন এপ্রিলে শুরু। পশ্চিমবঙ্গেও তা-ই ছিল, পরে প্রতিবছর এক মাস পিছিয়ে এটা এখন জানুয়ারিতে। তেমন প্রয়োজন মনে করলে আমরাও পরবর্তী তিন বছরে এক মাস করে পিছিয়ে আবার জানুয়ারিতে ফেরত আসতে পারি। এটা এমন কঠিন কিছু নয়। বাস্তব অবস্থার নিরিখে একটা যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার শুধু। সরকার এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা একটু ভেবে দেখবেন কি? 

লেখক : মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028119087219238